করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিতে হলেন করতে হবে নিবন্ধন। জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে আজ সোমবার (২৬ জানুয়ারি) থেকে এ নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে গত ১১ জানুয়ারি এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম জানিয়েছেন, সোমবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে অ্যাপ ও নিবন্ধনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে।
সারা দেশের মানুষকে করোনার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে গণ টিকাদান শুরুর আগে সামনের সারিতে থাকা কর্মীদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি অ্যাপ চালুর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। এরইমধ্যে গত ২১ জানুয়ারি উপহার হিসেবে ভারতের পাঠানো করোনা ভাইরাসের ২০ লাখ ডোজ টিকা দেশে পৌঁছে।
সবশেষ গতকাল বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ নামের করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপে ৫০ লাখ ডোজ দেশে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৭ জানুয়ারি একজন নার্সকে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দেশে প্রাথমিকভাবে টিকা দান কার্যক্রম শুরু হবে। ওইদিন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আরও ২৪ জনকে টিকা প্রয়োগের কথা রয়েছে। পরদিন ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর ৫টি হাসপাতালে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার আরও ৪ থেকে ৫ জনকে এ টিকা দেয়া হবে। টিকা দিয়ে তাদের ৬-৭ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এই সময়ের মধ্যে টিকা গ্রহণকারীদের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দিলে কিংবা বড় কোনও সমস্যা না হলে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হবে।
বাংলাদেশ সেরাম ইন্সটিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিলেও যেহেতু এখানে এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি, তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, প্রথম দফায় টিকা পাওয়া সবাইকে এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশ টিকাদান মহাযজ্ঞের পরিকল্পনা রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের।
এদিকে টিকা পেতে আগ্রহী সবাইকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। সেজন্য ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তালিকা ঠিক করতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামের তালিকা চেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
ভারত থেকে আনা ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন মহলে যখন সন্দেহ, সংশয় ও উদ্বেগ বিরাজ করছে তখন টিকা নেয়ায় মানুষকে কীভাবে মানুষকে আশ্বস্ত ও আগ্রহী করবে সরকার, এমন প্রশ্নে গত রবিবার (২৪ জানুয়ারি) সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ পর্যন্ত যতগুলো ভ্যাকসিন বিশ্বে রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। এসব ভ্যাকসিন থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম হয়েছে। ভারত ও যুক্তরাজ্যে লাখ লাখ ভ্যাকসিন প্রয়োগ হয়েছে। তাই এ ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের প্রয়োজন নেই। কাউকে জোর করে ভ্যাকসিন দেয়া হবে না, যে স্বাধীনভাবে ভ্যাকসিন নিতে চায় তাকেই দেয়া হবে।’
কীভাবে করবেন অনলাইনে নিবন্ধন:
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের টিকা পেতে আগ্রহীরা সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www.surokkha.gov.bd) গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধন করতে পারবেন। এছাড়া ‘রিয়েল টাইম’ অ্যাপটি ফ্রি ডাউনলোড করা যাবে। নিবন্ধনের পর সেখান থেকেই জানা যাবে, কবে কখন টিকা নিতে হবে।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের ওপর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না হওয়ায় আপাতত ১৮ বছরের কম বয়সীদের টিকার জন্য নিবন্ধিত করা হবে না। পরিচয় যাচাইয়ে এ অ্যাপ্লিকেশনে ১৮ শ্রেণি করা হয়েছে, যার একটি সিলেক্ট করার পর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে নিবন্ধনের কাজ শুরু করতে হবে।
যে ১৮টি শ্রেণি রয়েছে তার মধ্যে নাগরিক নিবন্ধন, সরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী; অনুমোদিত সকল বেসরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা-কর্মচারী; প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত সকল সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা কর্মকর্তা-কর্মচারী; বীর মুক্তিযোদ্ধা; সম্মুখসারির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য; সামরিক ও আধা সামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয়ের কর্মীরা।
এছাড়াও এই ১৮টি শ্রেণিতে রয়েছেন, সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী; নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি; সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সম্মুখসারির কর্মকর্তা-কর্মচারী, ধর্মীয় প্রতিনিধি (সকল ধর্ম); মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত ব্যক্তি; বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন ও ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি সেবার সম্মুখসারির কর্মী; রেল স্টেশন, বিমানবন্দর, নৌবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী; জেলা ও উপজেলায় জরুরি জনসেবায় সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংক কর্মী ও প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক।
নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর যাচাই করে সব ঠিক থাকলে স্ক্রিনে নিবন্ধনকারীর নাম দেখানো হবে বাংলা ও ইংরেজিতে। সেখানে একটি ঘরে একটি মোবাইল ফোনের নম্বর চাওয়া হবে, সেই নম্বরেই উক্ত ব্যক্তিকে টিকাদান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এসএমএস-এর মাধ্যমে পাঠানো হবে।
মোবাইল ফোনের নম্বর দেয়ার পর একটি ঘর পূরণ করতে হবে, যেখানে জানাতে হবে নিবন্ধনকারীর দীর্ঘমেয়াদী রোগ বা কো-মরবিডিটি আছে কি-না, থাকলে কোন কোন রোগ আছে তাও জানাতে হবে। সেখানে আরেটি ঘরে জানাতে হবে নিবন্ধনকারীর পেশা ও তিনি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজে সরাসরি জড়িত কি-না।
এরপর নিবন্ধনকারীর বর্তমান ঠিকানা ও কোন কেন্দ্র থেকে টিকা নিতে ইচ্ছুক তা বাছাই করতে হবে। সবশেষ নিবন্ধন ফরম সেইভ করলে নিবন্ধনকারীর দেয়া মোবাইল নম্বরে পাঠানো হবে ওটিপি। সেই ওটিপি কোড দিয়ে ‘স্ট্যাটাস যাচাই’ বাটনে ক্লিস করলে নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন হবে।
নিবন্ধন হয়ে গেলে টিকার প্রথম ডোজের তারিখ ও কেন্দ্রের নাম এসএমএস-এর মাধ্যমে জানানো হবে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে এসএমএস-এর মাধ্যমে পাওয়া ওটিপি কোড দিয়ে টিকা কার্য ডাউনলোড করতে হবে।
এসএমএস-এ যে তারিখ দেয়া হবে সেই তারিখে টিকা কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নিবন্ধনকারী ব্যক্তি কোডিড-১৯ এর টিকা নিতে পারবেন।
এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টিকার দুই ডোজ নেয়া শেষ হলে সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন থেকে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির সনদ সংগ্রহ করা যাবে।
তবে ইন্টারনেট সুবিধা বা অ্যাপ ব্যবহারের মতো ডিভাইস যাদের নেই, তাদের জন্যও বিকল্প পথ খোলা রাখা হবে। এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম জানিয়েছেন, ‘যাদের ইন্টারনেট কিংবা অ্যাপ ব্যবহারের সুবিধা নেই সেইসব আগ্রহীদের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে ফ্রি নিবন্ধন করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই প্রস্তুতি চলছে।’