কাউন্সিলর দফতরের সামনে রুবেলের মূত্রত্যাগ


স্টাফ রিপোর্টার: ইতিহাসের প্রথম এমন এক কাণ্ডের সাক্ষী হলো রাজশাহী! নির্বাচনে পরাজিত হয়ে প্রতিশোধ নিতে বিজয়ী প্রার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক দফতরের সামনে গিয়ে প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করেছেন স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা। দলে কোন জায়গা না থাকা যুবলীগ নামধারী ওই ব্যক্তির নাম জহিরুল ইসলাম রুবেল। তিনি গত জুনে অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন।

ওই নির্বাচনে হেরে গিয়ে প্রতিশোধ নিতেই রুবেল এমন ঘৃণ্য কাজ ঘটিয়েছেন বলে দাবি করেছেন বর্তমান কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি। গত রোববার রাতে শহরের চন্ডিপুর-ঝাউতলা মোড় এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এ সংক্রান্ত একটি সিসিটিভি ফুটেজ ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে ভাইরাল হয়েছে।

ফুটেজটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত রোববার ২৭ আগস্ট রাত আটটার দিকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি রাসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতির প্রাতিষ্ঠানিক দফতরের সামনে এসে দাঁড়ায়। এরপর একরকম মদ্যপ অবস্থায় গাড়ির চালকের আসন থেকে নেমে আসেন পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী জহিরুল ইসলাম রুবেল। এর কিছুক্ষণ পর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়েই প্রকাশ্যে প্রস্রাব করেন তিনি।

ভিডিও ফুটেজটিতে দেখা যায়, তিনি প্রস্রাব করাকালীন কার্যালয়ে নিযুক্ত একজন নারী বের হয়ে আসার পরেও তিনি এ কাণ্ড চালিয়ে যান! এতে ওই নারীসহ আশপাশের অনেককেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে দেখা যায়। এভাবে প্রায় দুই থেকে তিন মিনিট চলার পরে আবারো নিজ গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন পুলিশের তালিকাভুক্ত স্থানীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে খ্যাত জহিরুল ইসলাম রুবেল। এদিকে, ভিডিও ফুটেজটি দেশজুড়ে ভাইরাল হওয়ার পরে এ ঘটনার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী ও বর্তমান কাউন্সিলর মতিউর রহমান।

তিনি বলেন, যে কার্যালয়ে তিনি এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন; সেটি আমার ব্যক্তিগত কোন অফিস নয়। এটি সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত স্থানীয় জনগণকে নাগরিক সেবা দেয়ার একটি স্থান। এই অফিস থেকেই এই ওয়ার্ডের জনগণ তাদের নাগরিক সেবা গ্রহণ করেন। আমার সঙ্গে তার মতবিরোধ থাকতেই পারে। তাই বলে সে যদি স্থানীয় সেবাদানকারী প্রাতিষ্ঠানিক দফতরের সামনে এমন হীন কর্মকাণ্ড করে; তবে সেটি শুধু আমার জন্য নয়- সমগ্র সিটি কর্পোরেশনের জন্য অপমানজনক! আমি আমার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের এ বিষয়ে অবগত করেছি। আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতিও চলছে।

এ বিষয়ে নগরীর রাজপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাজল নন্দী গণমাধ্যমকে বলেন, পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী রুবেল কার্যালয়ে প্রস্রাব করেছেন বলে বর্তমান কাউন্সিলর মতি মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। তাকে লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তিনি লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, ঘটনাটি আমি শুনেছি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক! স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কার্যালয়ে গিয়ে কেউই এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর অধিকার রাখে না। আমরা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাননীয় মেয়র মহোদয়কে (এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন) এ বিষয়ে অবগত করেছি। শীঘ্রই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বৈঠক করবো।

কে এই রুবেল? গত ৫ জুন শীর্ষ পর্যায়ের একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদনে জহিরুল ইসলাম রুবেলের বিভিন্ন অপকর্ম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজশাহীর শীর্ষ এই সন্ত্রাসীর ওপর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নজর রাখছেন বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। হলফনামায় নিজের অনেক অপকর্মের তথ্য লুকিয়ে রুবেল প্রার্থী হয়েছিলেন জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- মাদক ও অস্ত্র জগতের ডনখ্যাত রুবেলের ইশারাতেই চলে রাজশাহী মহানগর ও এর আশপাশের অপরাধ জগৎ।

নিজ এলাকা ছাড়াও নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায় রয়েছে তার দুর্র্ধষ ক্যাডার বাহিনী ও শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। এ ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমেই জমি দখল, মাদক, জুয়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন রুবেল। হাফডজন মামলার আসামি হয়েও নির্বাচনী হলফনামায় তথ্য গোপন করে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। সন্ত্রাসী রুবেলের দেয়া ওই সময়ের হলফনামা ঘেঁটে প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, নগরীর চন্ডিপুরের বাসিন্দা এইচএসসি পাস রুবেল ব্যবসায়ী।

বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বাসায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকামূল্যের ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকামূল্যের আসবাবপত্র রয়েছে। হত্যা, মাদক, অস্ত্র, পুলিশের ওপর হামলা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা চলমান। একটি হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু হলফনামার তথ্যের বাইরেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা। মামলার নথি অনুসন্ধান করে পত্রিকাটি জানায়, রুবেলের বিরুদ্ধে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের পবা থানায় ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর ৩০২/৩৪ ধারায় একটি মামলা হয়। যার এফআইআর নং-২০। ২০১৩ সালের ২২ জুলাই রাজপাড়া থানায় ৩২৩, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩৮০, ৪৪৮/৩৪ ধারার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রুবেল। রাজপাড়া থানায় ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৪৩, ৪৪৮, ৩৮৫, ৩৭৯, ৪৩৫, ৪২৭, ৫০৬ ধারার মামলার আসামিও তিনি।

২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩২৩, ৩২৫, ৩০৭, ৩৭৯ ধারার মামলাতেও রুবেল আসামি বলে জানা গেছে। এ ছাড়া জমি দখলের অভিযোগ তুলে নগরীর হরগ্রাম পূর্বপাড়া (বাগান পাড়া) এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম গত বছরের ১৭ মে কাশিয়াডাঙ্গা থানায় একটি মামলা করেন। এসব মামলার কোনোটিই রুবেলের হলফনামায় উল্লেখ নেই।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, এক সময়ের রাজশাহী মহানগর বিএনপির দুর্র্ধষ নেতা শফিকুল ইসলাম ওরফে কানা শফিকের (বছর দেড়েক আগে নগরীর দাশপুকুর এলাকায় জমি দখলের সময় প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত) হাত ধরে রুবেলের উত্থান। এরপর সড়ক ও জনপথের বিভিন্ন টেন্ডারবাজির মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে রুবেলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

এরপর এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে আরেক সন্ত্রাসী মাহাফুজের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘মায়া’ নামে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এ মায়া গ্রুপ গড়ে তোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন রুবেল এবং তার বড় ভাই ও ভাগ্নে।