চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিচারক হুমায়ুন কবীরের আবারও দৃষ্টান্ত স্থাপন


ফয়সাল আজম অপু : বিচারকের হস্তক্ষেপে দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ফিরে পেয়েছে তাঁর স্বামীকে, আর মায়ের গর্ভে থাকা অনাগত শিশু ফিরে পেয়েছে তাঁর বাবাকে। বৃহস্পতিবার এমনই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমলী দ্বিতীয় আদালতে। এ সময় আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল এম এম হুমায়ুন কবীর উপস্থিত ছিলেন।

আদালতের বিজ্ঞ বিচারক এম এম হুমায়ুন কবীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট করেছেন। পোস্ট করার কিছু সময়ের মধ্যেই পোস্টটি ভাইরাল হয়। অনেকেই বিজ্ঞ বিচারকের এমন নজিরবিহীন দৃষ্টান্তে প্রশংসাসংবলিত মন্তব্য করেছেন।

সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম এম হুমায়ুন কবীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া পোস্টে লিখেছেন, অবশেষে আমি সফল। সফল হলো দশ মাসের অন্তসত্ত্বা এবং তাঁর গর্ভের সন্তান। আমি পেলাম মানসিক শান্তি, আর তাঁরা পেল স্ত্রীর মর্যাদা এবং পিতৃ পরিচয়।

বরাবরের মতো সেদিনও আমি এজলাসে উঠলাম বিচার কার্য পরিচালনা করার জন্য। অনেকগুলো মামলার মধ্যে একটি মামলার ডাক পড়লো। মামলাটি যৌতুক নিরোধ আইনের অধীনে। আমি বাদিকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি সংসার করবেন? বাদী বলল, জ্বি মাননীয় আদালত। আমি আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটি কে জিজ্ঞাসা করলাম। আপনি কি সংসার করবেন? বললো না।

বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য শ্রবণ করলাম। নথি পর্যালোচনাঅন্তে দেখা যায় বাদীর সাথে আসামির গত বছরের ৭ এপ্রিল বিবাহ হয় এবং ওই বছরের ২৯ মার্চ তালাক হয়। মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০২২ সনের মার্চ মাসে। বাদিকে জিজ্ঞাসা করলাম তালাকের পরে কেন যৌতুকের মামলা করেছেন?

বাদী উত্তরে বললেন, মাননীয় আদালত আমি বর্তমানে দশ মাসের প্রেগন্যান্ট এবং আমার গর্ভের সন্তানের বাবা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ ব্যক্তি। আমি আসামিকে জিজ্ঞাসা করতেই আসামি বললেন, এটা মিথ্যা কথা মাননীয় আদালত। বাদির সাথে আজ থেকে ১৭ মাস আগে আমার তালাক হয়েছে ঐ সন্তান আমার হতে পারে না।

আমি উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বললাম এজলাস থেকে নেমে আমার খাস কামরায় বসবো। উভয় পক্ষকে নিয়ে আমার খাস কামরায় বসলাম। প্রথমে আসামির বক্তব্য শ্রবণ করলাম। কোন ক্লু বের করতে পারলাম না। তার একই কথা আমি বহু পূর্বেই বাদিকে তালাক দিয়েছি। এরপরে বাদীর বক্তব্য শ্রবণ করলাম। বাদি তার বক্তব্যে বললেন আসামি অর্থাৎ আমার স্বামী আমাকে ভুল বুঝিয়ে তালাকনামায় স্বাক্ষর নিয়েছে।

আমার স্বামী আমাকে বলেছে আমার পরিবার তোমার সঙ্গে বিয়ে মানছে না। তাই এই কাগজ দেখাতে হবে, যে তোমার সঙ্গে আমার তালাক হয়েছে। কিন্তু এটা প্রকৃত তালাক না। আমি তার কথায় বিশ্বাস করে তালাকনামায় স্বাক্ষর করেছি। আমি তালাকনামায় স্বাক্ষর করলেও আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই সংসার করেছি। আসামি বাদীর সমস্ত কথা অস্বীকার করলেন। এবার বাদী ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির একটি অডিও রেকর্ড শোনালেন। যেখানে একে অপরের রোমান্টিকতা স্পষ্টতো।

আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলাম। সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। সদা সত্য-সাক্ষ্য দেবে। ধৈর্য ধরে দেড় দুই ঘন্টা তাদের জন্য কাটিয়ে দিলাম। এবার আমি আবারো আসামিকে জিজ্ঞাসা করলাম তালাক পরবর্তী আপনি কি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন? আসামি স্বীকার করে বললেন, জি মাননীয় আদালত বাদী যা বলেছেন সেটাই ঠিক।

আমি কষ্ট নিয়ে অনেক কথা বলে ফেলেছি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। মনে হলো আমি এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ডাকলাম কাজী, পুণরায় দিলাম বিয়ে। বিবেকের জাগ্রতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যায়বিচার।

আদালতের এমন নজিরবিহীন বিচারকার্যে সর্বত্র প্রশংসায় ভাসছেন ম্যাজিস্ট্রেট এম এম হুমায়ুন কবীর। আদালত পাড়ায় ছিলো দিনভর গুঞ্জন। বাদী-বিবাদী ও আইনজীবী সবাই খুশি।