দীপক কুমার সরকার, বগুড়া: বাংলাদেশ সোনালী আঁশ বলে খ্যাত পাটের ওপর বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে আসছে সরকার। বেশী বেশী পাট চাষে আগ্রহী করতে কৃষি বিভাগ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্ত উপযুক্ত দামের অভাবে পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে বগুড়ার কৃষকেরা। চলতি মৌসুমে পাটের আবাদে খরচ বেড়েছে গত বছরের চেয়ে প্রায় ৬০০ টাকা পাটের দাম কম।
অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানি না থাকায় পাট ক্রয় করে লোকসান ঝুঁকিতে পড়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরাও। এমন পরিস্থিতিতে আগামিতে পাটের আবাদ ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন কৃষকেরা।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও দেখা যায়, জেলায় পাট চাষের পরিমাণ কমেছে। এবার উৎপাদন বেশি হলেও গত দু’বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এই অর্থকরী ফসলে। তবে সোনালী আঁশ উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবী করছেন জেলার কৃষি কর্মকর্তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বগুড়ায় পাট চাষে জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬৩৪ হেক্টর। বিপরীতে অর্জন হয় ১০ হাজার ৬৯০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন। জমি থেকে ফসলটি কাটা এখনও চলমান। তবে অর্জিত জমিতে উৎপাদনের হার পাওয়া যাচ্ছে ২ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন করে। এ হিসাবে মোট উৎপাদন হতে পারে প্রায় ৩০ হাজার ১৪৬ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে পাটের আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ১৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ১১ হাজার ১৬৭ হেক্টর। আর উৎপাদন পাওয়া যায় ৩০ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন।
গত রবিবার সরেজমিনে বগুড়ার সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা প্রতিমণ পাট ২২শ থেকে ২৪শ টাকায় বিক্রি করছেন। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাট চাষ হয় এই উপজেলায়, এবারের পরিমাণ ৫ হাজার ৭১৫ হেক্টর। এ জন্য এখানে আশেপাশের অনেক পাইকার আসেন পাট ক্রয় করতে।
তবে এসব দামে কৃষক সন্তুষ্ট নন। তাদের দাবী গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তবুও কৃষক আশায় ছিল পাটের দাম গত বছরের মতো থাকলেও লাভ হবে। শেষ পর্যন্ত তা আর থাকেনি। গত বছর প্রতিমণ পাট বিক্রি হয়েছিল দুই হাজার আটশ’ টাকা থেকে তিন হাজার দুশ’ টাকা। চলতি বছর প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকা থেকে দুই হাজার ২শ’ টাকা’। তবে দু তিন দিন ধরে এই দাম একটু বেড়েছে।
পাট চাষে অন্য খরচ তেমন না থাকলেও কৃষি মজুরের খরচ বেশি। প্রতি বিঘায় চাষ থেকে শুরু করে পাট ঘরে তুলতে তিন দফায় অন্তত ১৪ জন শ্রমিক প্রয়োজন। শ্রমিক প্রতি এবার দিতে হয়েছে ৬’শ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ মিলে প্রতি বিঘা পাট চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আবার হাটে আনা নেয়াতেও আছে খরচ। খেত থেকে পাট কেটে জাগ দিয়ে শুকিয়ে হাটে নেওয়ার পর দাম শুনে কৃষক হতাশ।
সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা গ্রামের এনামুল হক বলেন, আমার ১’শ শতক জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এখন দাম যাচ্ছে ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা মণ। এই দামে খরচ উঠবে না। এ রকম থাকলে আগামীতে এই ফসল আর করা যাবে না।
কৃষক এনামুলের মতো উপজেলার উল্যাডাঙ্গা গ্রামের লেবু প্রামানিক, যমুনাতীরের কৃষক আফাজ উদ্দিন সহ একাধিকরা বলেন, পাট চাষ করার পর শুকিয়ে হাট বিক্রি করে দেখা যায় ব্যয়ই বেশী, পাট এভাবে করা যাবি না। এখন বীজ, সারের দাম বেশি। তাইতো খরচে পোষাচ্ছে না।
সারিয়াকান্দির চর মথুরাপাড়া হাটের বড় পাইকাড় হাসান আলী বলেন, প্রতিবছর এই সময়টায় হাটে গড়ে অন্তত ৬’শ মণ পাট উঠত। গত বছর থেকে পাটের আমদানি কমেছে। চলতি মৌসুমে কোনোদিন ২’শ মণ, কোনোদিন ৩’শ মণ পাট উঠছে। উন্নতজাতের পাটের দাম কিছুটা বেশি। এই জাতের পাট খুব কম আসছে। সব মিলিয়ে চলতি পাট মৌসুম কৃষকদের হতাশায় ফেলেছে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সহ সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, বগুড়ায় যেসব মিল-কারখানা আছে তারা পাটের ফিনিশড গুড(পাটজাত দ্রব্য) ইন্ডিয়াতে রপ্তানি করে থাকে। ইন্ডিয়াতে পাটের বিশাল মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়াও এসব পণ্য রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার অনেক দেশে আমাদের পাটের ফিনিশড পণ্য যায়।
গত বছরে রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়ে। চলতি বছর সবচেয়ে বেশি ভাটা পড়ে রপ্তানি অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। এ বছর সীমিত পাট কিনে কোনো রকমে মিল চালু রাখা হয়েছে। একই কারণে পাটের দামেও প্রভাব পড়েছে। তবে এক্ষেত্রে সরকার যদি কৃষকদের প্রণোদনার হার বাড়িয়ে দেয় এবং যে ফিনিশড গুড রপ্তানি হয়, সেদিকে সু-নজর দেয়, তাহলে হয়তো আগামিতে পাটে আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতলুবর রহমান বলেন, পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে চলতি বছরে বগুড়ায় ১০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বীজ দেয়া হয়েছে। পাট চাষে মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম থাকায় কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে মৌসুমের মাঝামাঝিতে এসে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় পাট পচানোর কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে কৃষকেরা। তবে এবার ফলন ভালো হয়েছে।
বর্তমানে পাটের মান অনুযায়ী প্রতি মণে ২ হাজার থেকে ২৫শ টাকা দাম পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু পাটের কল আছে, যারা কিনা পাটজাত দ্রব্য যেমন বস্তা তৈরি করে রপ্তানি করছে। যদি এই পাট রপ্তানিটা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের কৃষক ভাইয়ের যথেষ্ট ভালো দাম পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ওই কর্মকর্তা।