॥ শহীদ সিরাজী ॥
খবরটা ঢাকা থাকলো না। পৌঁছে গেল দ্রুত ঢাকা থেকে কক্সবাজারে। শুনেই দীপ্তর মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। দেহটাও দুলে উঠলো। ভয়ানক খবর! ছোট ভাই মুগ্ধ আর নেই পৃথিবীতে। বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে শহীদ হয়েছে। মেনে নিতে পারছে না সে। মা হার্টের রোগী, তাকে বলবে কী করে!
বাবা ও মাকে নিয়ে দীপ্ত এসেছে কক্সবাজারে। মা কখনো সাগর দেখেনি কিনা তাই। এ যাত্রায় তার ছোট দুই যমজ মুগ্ধ আর স্নিগ্ধ আসেনি। ভিন্ন পরিকল্পনা ওদের। দেশে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলন চলছে। ওরাও যোগ দেবে, আন্দোলন করবে।
সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ কতদিন মানুষ সহ্য করবে? গুম, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড; এখন দেশের প্রতিদিনের ঘটনা! জীবনের নিরাপত্তা নেই। দেশের সম্পদেরও চলছে হরিলুট। বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নামে চলছে লুটপাট, ঘুষ-বাণিজ্য। মানুষের শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা সবকিছুই দেশ থেকে ফেরার। মানবতাও কর্পূর হয়ে হাওয়ায় মিলে গেছে। কাঁদছে দেশ ও জনতা।
আর বাজার সিন্ডিকেট! এক ভয়াবহ অবস্থা। মানুষ এখন অসহায়। প্রতিনিয়তই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। যেভাবে বাড়ছে ক্রমেই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আর কতদিন সহ্য করবে দেশের মানুষ? সকলের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
এদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলন করবে না কেন? ওরা তো এ প্রজন্মের। সচেতন ও সাহসী। সবকিছুই ঘটছে তাদের চোখের সামনে। সরকারের একচোখা নীতি তারা দেখছে। লেখাপড়া করে, ভালো রেজাল্ট করেও তারা চাকরি পাচ্ছে না অথচ সরকার কোটার নামে দলীয় ক্যাডারদের চাকরি দিচ্ছে। মেধাবীরা মেধার কোনো মূল্য পাচ্ছে না। চাকরি না পেয়ে অনেকেই দেশ ছাড়ছে। মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার হওয়া দরকার।
এসব কারণে ক্রমেই আন্দোলন বেগবান হচ্ছে। রাজধানীর থেকে গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে সে আন্দোলন। একপর্যায়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের পিটুনি দেখে শিক্ষকরাও বসে থাকতে পারেননি। বেরিয়ে এসেছেন রাজপথে। এসেছেন ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা-মা’রাও।
১৮ জুলাই। রাজধানীর উত্তরা আজমপুর। সকাল থেকেই ছাত্ররা রাজপথ দখল করে রেখেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে এখন তাদের এক দফা দাবি। চলছে মিছিল স্লোগান। হাজার হাজার মানুষের গণদাবি নিয়ে পুরো এলাকা মুখরিত। দাবি আদায় না করে তারা ঘরে ফিরবে না। পুলিশের সাথে কয়েক দফা ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়ে গেছে, তবুও পথ ছাড়েনি ছাত্র-জনতা। সকাল থেকেই চলে আসা আন্দোলন দুপুর গড়ালো। সকলেই শ্রান্ত-ক্লান্ত, তবুও বিশ্রামহীনভাবে রাজপথ দখল করে আছে তারা।
এলাকার ছেলে মুগ্ধ। সেও বসে থাকতে পারেনি। নেমে এসেছে রাজপথে। ব্যতিক্রম সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনরত ছেলেদের পানি পান করাচ্ছে। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই তার। সেই সকাল থেকে দুই হাতে পানির কেস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে আর বলছে, ‘পানি লাগবে পানি?’
এভাবেই ক্লান্ত, পিপাসার্ত ছেলেদের মাঝে পানি বিতরণ করছিল।
সবই ঠিকঠাক চলছিল। আন্দোলন ক্রমেই তুঙ্গে উঠছিল। চারদিকে হইচই, স্লোগান মিছিলে লাখোকণ্ঠের গগনবিদারী চিৎকারও চলছিল সমানভাবে। তখনই হঠাৎ দেখা গেল পুলিশের মারমুখী আচরণ। ছাত্র-জনতার ওপর ছুড়তে লাগলো টিয়ার গ্যাস। সকলের চোখ জ্বালা করতে লাগলো।
শুধু টিয়ার গ্যাস নয়, সাথে বৃষ্টির মতো গুলি ছুটে আসতে লাগলো। স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের ওপর চড়াও হয়ে গুলি করতে লাগলো। ভয়ংকর অবস্থা! মাত্র ১৫ মিনিটে সব শেষ হয়ে গেল। অনেকে গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। অনেকে হতাহত হলো।
সাহসি মুগ্ধ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল। একটি গুলি এসে তার কপালে লাগলো। সাথে সাথে সে লুটিয়ে পড়ল। তবে বন্ধুরা তাকে ছাড়লো না দ্রুতই পাশের ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেল। ততক্ষণে যা হবার তাই হলো। হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মুগ্ধ মারা গেল।
মুগ্ধ ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল সরব। ছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের রোভার স্কাউট, ইউনিট লিডার। সমাজসেবীও। ২০১৯ সালে যখন বনানীতে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল, তখন উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। সেজন্য বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ অর্জনও করেছিল মুগ্ধ। শুরু থেকেই সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহায়তা করে আসছিল। তার বিশ্বাস ছিল শিক্ষার্থীরা ন্যায়সঙ্গত লড়াই করছে।
মুগ্ধ ছিল যেমন সাহসী তেমনি সমাজসেবী। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল, ‘জীবন অর্থবহ হোক, দীর্ঘ নয়।’ সত্যিই জীবনকে অর্থবহ করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সে। আহা মৃত্যু কি মর্মান্তুদ!
এমন ভয়ানক সময়ে বড় ভাই দীপ্ত কক্সবাজারে। মা কখনো সমুদ্রসৈকত দেখেননি বলে নিয়ে এসেছে কক্সবাজারে। গত বছর বাবা-মাকে প্রথমবারের মতো সুন্দরবনে নিয়ে গিয়েছিল মুগ্ধ। তাই এবার সে বাবা-মাকে নিয়ে কক্সবাজারে এসেছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুগ্ধর মৃত্যুর খবর পেল দীপ্ত। পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগলো ঢাকায় ফেরার। কিন্তু বৃদ্ধ অসুস্থ হার্টের রোগী মাকে নিয়ে কীভাবে সে ঢাকায় ফিরবে?
এদিকে মাকেই-বা কীভাবে বোঝাবে, বলবে। তখন কোনো ফ্লাইটও পেলো না বিমানের। শেষে পরের দিন তারা ঢাকায় ফিরলো।
ফেরার আগে বাবা-মাকে মুগ্ধর ব্যাপারে সেটা আভাস দিয়ে বলল, মুগ্ধ সামান্য আহত হয়েছে। হাসপাতালে আছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে শেষমেশ দেয়া হলো তার মৃত্যুর খবর। শুনেই মা ভেঙে পড়লেন। তখন থেকেই তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি।
মেধাবী ছাত্র মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে এমবিএ করতে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। সেই মুগ্ধ এখন নেই। সকলকে ফেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে। ভুলতে পারছে না তার যমজ ভাই স্নিগ্ধ। তাদের দুজনে একসাথে টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। স্নিগ্ধর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতি জড়িয়ে ছিল মুগ্ধ; সে আজ নেই। সে শুধু ভাই হারায়নি, হারিয়েছে তার নিজের জীবনের একটা অংশকে।
এসব ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধ এখন ট্রমায়। একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে।
আর মা! তিন ভাইয়ের মধ্যে মুগ্ধই ছিল মায়ের সবচেয়ে কাছের। তার মৃত্যুতে মায়ের দুনিয়াটা আঁধার হয়ে গেছে।
মৃত্যুর সময় পাশে ছিল বন্ধু জাকিরুল। তার কষ্টটাও অবর্ণনীয়। চোখের সামনেই সব ঘটেছে তার। বুলেট মুগ্ধর কপালে লেগে মাথার ডান দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তার চোখের সামনে মারা যায় সে।
সেই জাকিরুলের প্রশ্ন, মুগ্ধতো পানি খাওয়াচ্ছিল সকলকে। তার কিংবা আমাদের দেশের কারো কাছে ছিল না কোনো ধরনের অস্ত্র বা লাঠিসোঁটা। তারপরও ওরা মুগ্ধকে গুলি করে মারলো কেন?
মুগ্ধ এখন নেই পৃথিবীতে। শহীদ হয়ে তার পবিত্র আত্মা বেহেশতের বাগানে উড়ছে। তবে তার ও আর সব শহীদের রক্তের বিনিময়ে নতুনভাবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। বন্ধু জাকিরুলের মতো সকলের প্রশ্ন- ওরা মুগ্ধকে শহীদ করল কেন? সে তো সকলকে পানি খাওয়াচ্ছিল আর বলছিল ‘পানি লাগবে পানি’ ?
সংগ্রহ: সাপ্তাহিক সোনার বংলা