দীপক কুমার সরকার, বগুড়া: “সরিষা ফুলের সোনালি রঙ জীবনের সব দুঃখের মাঝে এক নতুন আশা বয়ে আনে” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যের সাথে জীবনের কাব্য মিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতি আমাদের হৃদয়-মনকে নাঙিয়ে দেয়। শীতের ভোরে বিন্দু বিন্দু শিশির¯œাত মাঠে সরিষা ফুলের মৌ মৌ সুঘ্রাণ ও সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভোরের কাঁচাসোনা রোদে ম্রিয়মান বাতাসে হলুদাভ ঢেউ দিগন্তজোড়া মাঠে। গাঢ় হলুদ বর্ণের সরিষা ফুলে মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে মধু আহরণ করছে। বিস্তীর্ণ এলাকার ক্ষেতগুলো দেখে বিছানো হলুদ গালিচা বলে ভুল হওয়া বিচিত্র নয়। ভোরের মিষ্টি সোনারোদে ঝলমল করা অপরূপ রাণী হলুদ সরিষা ফুলের অবারিত সৌন্দর্য্যের মুগ্ধতা এখন লুটোপুটি খাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। এমন দৃশ্য থেকে পিছিয়ে নেই বগুড়ার জেলা। এ অঞ্চলের প্রতিটি মাঠে মাঠে এখন সরিষা ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সরিষা চাষিরা বাম্পার ফলনের আশা করছে। ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেলের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাম বেশি হওয়ায় আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের। অন্যান্য ফসলের তুলনায় সরিষা চাষে কম খরচ, কম শ্রম এবং দ্রুত ফলন পাওয়া যায়। যে কারণে চাষিরা আবাদে লাভ বেশি পায়। এছাড়াও সরিষা চাষ করলে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় আর সরিষা তোলার পর বোরো ধান রোপণ করা সম্ভব। যার কারণে প্রতি বছরই সরিষার চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বগুড়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে সরিষার। জেলার পাঁচটি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সরিষা আবাদ করে থাকে কৃষকরা। প্রতি বিঘা জমি থেকে চলতি মৌসুমে গড় ৫ থেকে ৬ মণ হারে সরিষার ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে হলুদ চাদরে বিছানো সরিষা ক্ষেতে সরিষা চাষি ও মৌ-চাষিরা এ মুহুর্তে ব্যস্ত সময় পার করছে। বগুড়ায় সরিষা চাষের বিপ্লব হওয়ায় দেশের সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা মধু সংগ্রহকারী চাষিরা বগুড়ায় এসে ডেরা বসিয়েছে। সরিষা ক্ষেতের কোলঘেঁষে বসিয়েছে মৌমাছির বাক্স।
মধু চাষিরা জানান সরিষার সময় ছাড়াও কালোজিরার মধু, লিচু ফুলের মধু খেসারীর ডালের মধুও তারা সংগ্রহ করে থাকে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে জেলায় সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা। সরিষার দামও ভালো পাওয়ার আশা করছেন এ জেলার চাষিরা। চাষিরা বলছে, সরিষা তেলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে সরিষার দাম এখন বেশ ভালো। বাজার পরিস্থিতি এমন থাকলে এবারও ভালো আয় হবে সরিষা বিক্রিতে।
চলতি রবি মৌসুমে বগুড়ায় ৪৭ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। তবে আবাদ হয়েছে ৩৭ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে। প্রায় সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমিতে এবার সরিষার আবাদ হয়নি। গত বছর জেলার ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে তেলবীজ জাতীয় এই ফসলের আবাদ হয়েছিল। কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমন আবাদে ধান কাটতে দেরি হয়েছে। কিছু জমিতে সবজি চাষের কারণে সরিষার জমি কমেছে। এখন পর্যন্ত ছত্রাক বা রোগবালাই না থাকায় বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
বগুড়া সদর, শেরপুর, শিবগঞ্জ, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া, কাহালু, আদমদীঘি, সোনাতলা ও গাবতলী উপজেলায় সরিষার আবাদ বেশি হয়। গত বছর সরিষা উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৭৫ হাজার টন। চলতি মৌসুমে ফলন ৬০ হাজার টন উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নন্দীগ্রাম উপজেলার ওমরপুর গুন্দইল গ্রামের চাষি বেলাল হোসেন টুকু জানান, চলতি মৌসুমে সরিষা চাষ কমেছে। অনেকে সবজি চাষ করছেন। গত বছর বিঘা প্রতি জমিতে গড়ে ৭-৮ মণ সরিষা ফলন হয়েছিল। চলতি মৌসুমের ২৫ অক্টোবর থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে বীজ বপন করেছেন। সরিষার ফুল ফুটেছে। এখনো রোগবালাই নেই, চাষিরা বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
অপরদিকে শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, এবার এ উপজেলায় ৩ হাজার ৭শ’ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও অর্জিত হয়েছে ২ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমি। যা গত বছর ছিল ৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৬৫ মেট্রিকটন।
এরমধ্যে টরি-৭ জাতের সরিষা ৪১০ হেক্টর, বিনা সরিষা-৯ জাতের ১২৬ হেক্টর, বিনা সরিষা-১১ জাতের ৫ হেক্টর, বারি সরিষা-১৪ জাতের ১ হাজার ৮৬১ হেক্টর, বারি সরিষা-১৭ জাতের ২৭৫ হেক্টর, বারি সরিষা-১৮ জাতের ৩ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হবে বলে উপজেলা কৃষি অফিসার ফারজানা আক্তার জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এবার একটু বেশী সরিষা চাষের দিকে আগ্রহ হয়েছে কৃষক। চলতি রবিআবহাওয়া কৃষির জন্য অনুকূল হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। বাজারে সরিষা তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে সরিষা ভালো দামে বিক্রিও করতে পারছেন।
উপজেলার খামারকান্দি গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, সরিষা চাষে দু’টি লাভ হয়। প্রথমত হলো দুই আবাদের মাঝখানে যে সময়টুকু পাওয়া যায় সেই সময়েই এই আবাদ ঘরে তোলা যায়। এছাড়াও ভালো ফলনের পাশাপাশি বাজারে ভালো দাম পেলে ভালো লাভ হয়। দ্বিতীয়ত সরিষা চাষের সময় যে পরিমাণ রাসায়নিক ও জৈব সার ব্যবহার করা হয় তাতে পরবর্তীতে ধানের আবাদের সময় নতুন করে আর কোন সার দিতে হয় না। ফলে ধান চাষে কম খরচে ফসল ঘরে তোলা যায়।
এ প্রসঙ্গে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে সরিষা চাষের জমি কমেছে ৯ হাজার ৫৪৮ হেক্টর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার উচ্চ ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি হেক্টরে ফলন ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৬ টন। ৬০ হাজার টন সরিষা উৎপাদন হতে পারে।