দীপক কুমার সরকার, বগুড়া: ‘আল্লাহ-রসুলের নাম লইয়া নাও খোলোরে/ সোনার নায়ে পবনের বৈঠা ধর রে/’ আবার কখনও স্থানীয় এলাকার নামের সাথে সংগতি‘ হাউস কইর্যা করাইলাম বিয়া…. দীঘলকান্দির চরেতে…… বউ পালালো শউরি জ্বালাতে’ গান তৈরী করে তার সাথে হেইয়্যাবোল-হেইয়্যাবোল।’ গানের তালে তালে নৌকা বাইচে অংশ গ্রহন করে মাঝি-মাল্লারা।
নৌকা বাইচ গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। নব্বই দশকের এক উৎসবের নাম ছিল নৌকা বাইচ। কিন্তুএকবিংশ শতাব্দীতে নদী- খালের নাব্যতা না থাকায় খুব বেশি চোখে না। তবে অপরুপ গ্রাম-বাংলার চিরাচরিত ঐতিহ্য ও শতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতির অন্যতম সংস্কৃতি নৌকা বাইচ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের গ্রামীন লোক সংস্কৃতির সেই ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে বগুড়ার করতোয়া নদীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ।
নৌকা বাইচ দেখতে দর্শনার্থীরা দূর-দূরান্ত থেকে আসতে থাকে সকাল থেকেই। শহরে মালতিনগর এসপি ব্রিজ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বেজোড়া ব্রিজ পর্যন্ত নৌকাবাইচ দেখতে স্থানীয় লোকজন ছুটে আসেন। নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই শহরের দুই এলাকায় উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধসহ লাখো মানুষ এ বাইচ উপভোগ করতে উপস্থিত হয়ে মিলনমেলায় মেতে উঠে আনন্দ-উল্লাসে। করতোয়া নদীর পাড়ে বিভিন্ন খাবারের পসরা নিয়ে বসে গ্রাম্যমেলা। তবে নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা দেখতে অনেকে নদীর তীরে জায়গা না পেয়ে পাশের ভবনের ছাদে নয়তো গাছের ডালে ওঠেন।
বগুড়া জেলা পুলিশের আয়োজনে, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বগুড়ার সহযোগিতায় সোমবার বেলা ১১টায় এসপি ব্রিজ নাম পরিচিত ঘাটে এ প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী।
আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর করতোয়া নদীর দুইপাড়ে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়। এতে জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আশেপাশের এলাকা থেকে রং-বেরংয়ের নৌকা এই আয়োজনে অংশ নেয়। নৌকা বাইচ শুরু হলে পুরো এলাকাজুড়ে নৌকার বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ‘হেইওরে, হেইওরে’ ডাকে মুখরিত হয়ে উঠে।
বাদ্য-বাজনা আর ভাটিয়ালি-জারি গানের সঙ্গে নৌকাবাইচ উপভোগ করেন বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লাখো মানুষ। নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় চলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।
বাইচ দেখতে আসা আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘নৌকা বাইচ উপলক্ষে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছি। অনেক দিন পর নৌকা বাইচ দেখলাম। সবাই মিলে উপভোগ করছি, খুব ভালো লাগছে। শহরের মধ্যে এখন তো তেমন নৌকা বাইচ দেখাই যায় না।’
ষাটোর্ধ বয়সী আজিজুল হক বলেন, ‘আমাদের বাড়ী যমুনা নদীর পাড়ে। সেখানে আগে নৌকা বাইচ হতো। তৎকালীন সময়ে নৌকা বাইচ কেন্দ্র করে কয়েকদিন গ্রাম্য মেলা বসতো। কিন্তু নদী নালা শুকিয়ে যাওয়ায় এবং মানুষের মধ্যে পুরাতন ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ায় এ উৎসবগুলো আর হয়না। তবে বহুত দিন পরে এমন আয়োজন, সত্যি হারানো ইতিহাস-ঐতিহ্যকে নতুন প্রজম্মদের মাঝে চেতনা জাগ্রত করবে।
প্রিয়ন্তী নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এ করতোয়া নদীতে মেলাদিন পর নৌকা বাইচ খেলা হয়। নৌকা বাইচ উপলক্ষে এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনরা বেড়াতে এসেছেন। বাড়ির কাজ-কর্ম শেষ করে সবাই মিলে নদীর পাড়ে বসে নৌকা বাইচ উপভোগ করতে এসেছি।’
তথ্যসুত্রে জানা যায়, করতোয়া নদীতে নৌকা বাইচের এটি তৃতীয় আয়োজন। ২০১৮ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম আসর, এরপর জেলা পুলিশের আয়োজনে ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের ব্যবস্থাপনায় ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় আয়োজন। তৃতীয় বারের মত আয়োজিত নৌকা বাইচের এবারের স্লোগান নদী বাঁচলে, পরিবেশ বাঁচবে। নদী বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও।
নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বগুড়া-৬ সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু। জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মাদ শফিউল আজম। এসময় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহাদৎ আলম ঝুনু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান ময়না প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় বগুড়ার গাবতলী, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার ৮টি নৌকা অংশগ্র্রহণ করে। পরে চারটি দল উড়াল পঙ্খি, সততা, কিং খান এবং রাখে আল্লা মারে কে সেমিফাইনালে প্রতিযোগিতা করে। পরে উড়াল পঙ্খি বনাম সততার মধ্যে ফাইনাল রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। এতে গাবতলী উপজেলার বালিয়াদিঘীর কালাইহাটা গ্রামের উড়াল পঙ্খি চ্যাম্পিয়ন বিজয়ী ও শেরপুর উপজেলার সততা নৌকা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। শেষে প্রধান অতিথিসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন।
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, সকলের সহযোগিতায় এর আগে করতোয়া নদীর কচুরিপানা অপসারণ করা হয়েছে। নদীর প্রবাহে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী এই করতোয়া নদী। নদীর নাব্যতা ফেরাতে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও করতোয়া নদী সংরক্ষণে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সেটি অনুমোদন হয়ে গেছে। আমরা মনে করি নদী বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে। তাই এই নদী সংরক্ষণে আমাদের সবার সচেতন হতে হবে।