সত্যজিতের ভাবনা-সুব্রতের লেন্সের জাদুকাঠি ম্যাজিক ছড়িয়েছিল পর্দায়


খুঁতখুঁতে কি বলা চলে তাঁকে? বা কাজের জন্য উন্নাসিক? Art for Art’s sake-এর জন্য কতদূর যাওয়া যেতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন সুব্রত মিত্র। এক ডাকে অনেকেই চিনবেন না তাঁকে। স্বাভাবিকও সেটা। ক্যামেরার পিছনের শিল্পীকে কতজনই বা চেনেন। তবে চিনেছিলেন একজন। তিনি সত্যজিত রায়। তাই হয়ত পর্দায় তৈরি হয়েছিল একের পর এক মাইলস্টোন, একের পর ম্যাজিক। যে জাদুতে আজও ঘোর লাগে আম বাঙালির।

সত্যজিত যদি স্বপ্ন দেখেন, তবে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন সুব্রত। ক্যামেরা নিয়ে এই সিনেমাটোগ্রাফারের জুড়ি মেলা যে ভার, তা বুঝেছিলেন সত্যজিত (Subrata-Satyajit combination)। কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন সুব্রত, একটা ঘটনাই তার প্রমাণ। একবার সুব্রত একটি টোস্টার কেনেন। বাড়ি ফিরে সেই টোস্টারের পরীক্ষা শুরু হয়। সঙ্গে ছিল নানা আকারের, নানা ধরণের পাউরুটি। কিন্তু কোনও আকারের রুটিকেই সঠিকভাবে টোস্ট করতে পারেনি ওই টোস্টার। এরপর নতুন কেনা টোস্টারটি কার্যত বাতিল ঘোষণা করে দোকানে ফেরত দিয়ে আসেন সুব্রত।

যে কোনও কাজের ব্যাপারে ঠিক এতটাই খুঁতখুঁতে ছিলেন তিনি। একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল চায়ের লিকারের। সেই লিকারের রং সঠিক হওয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি চা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। বিজ্ঞাপনের সেই শুটিং টিম ভেবেছিল, ভদ্রলোকের মাথায় বোধহয় কিছু সমস্যা রয়েছে। নিজের কাজ নিয়ে এতটাই গভীরভাবে ভাবতেন সুব্রত।

আলোর খেলা থেকে ছায়ার ঘনত্ব-সবেতেই কড়া নজর থাকত সুব্রত মিত্রের। তাঁর হাতে ক্যামেরা ছেড়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত থাকতেন সত্যজিত। কারণ তিনিও ততটাই কাজ নিয়ে খুঁতখুঁতে ছিলেন। প্রথম শটের একটা মাকড়সার জালও যাতে নষ্ট না হয়, দ্বিতীয় শটে সেই খেয়ালও রাখতেন মানিক বাবু (Throw back to the golden era of Ray)। তার ছাপ মিলেছে পথের পাঁচালিতে। লিরিকাল রিয়ালিজমের দুর্দান্ত উপস্থাপনা নজর কেড়েছিল দেশ বিদেশের নামকরা পরিচালকের। বর্ষার আগমনে জলপদ্মের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা বা বৃষ্টিতে ভেজা অপু দুর্গার সেই দৃশ্য জীবনে ভোলার নয়।

৩০ বছরের কেরিয়ারে মাত্র ১৭টি ছবিতে ক্যামেরা ধরেছিলেন সুব্রত মিত্র। এর মধ্যে ১০টি ছবিই সত্যজিত রায়ের সঙ্গে। ১৯৫৫তে তৈরি হয় পথের পাঁচালি। এরপর একে একে জলসাঘর, দেবী, মহানগর, চারুলতা, শেষ হয় ১৯৬৬তে নায়কের হাত ধরে (Golden moments of cinema)।

১৯৩০ সালে ১২ অক্টোবর বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুব্রত মিত্র। স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি সহপাঠীদের সাথে কাছাকাছি সিনেমা হলে ব্রিটিশ এবং হলিউডের চলচ্চিত্র দেখতেন। কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ঠিক করেন তিনি একজন আর্কিটেক্ট নয়তো একজন চিত্রগ্রাহক হবেন। তিনি ক্যামেরা সহকারীর কোন কাজ না পেয়ে বিজ্ঞানে ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা করতে থাকেন । ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিসাবে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা হয়। পর্দায় ম্যাজিক তৈরির সেই শুরু। আজও যার মুগ্ধতার রেশ কাটেনি।