আখের সাথে সাথীফসল চাষ করে নতুন দিগন্তের সূচনা


মোঃ মোহাইমেনউল (স্বপন), চারঘাট প্রতিনিধি : আখ আমাদের দেশের খাদ্য ও শিল্পে ব্যবহার্য অত্যন্ক গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল। চিনি, গুড় ও চিবিয়ে খাওয়ার জন্য আখ ফসল চাষ করা হয়ে থাকে। আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল, যা জমিতে প্রায় ১২-১৪ মাস থাকে। যদিও চিবিয়ে খাওয়া আখ ৮-৯ মাসেই কর্তন করা যায়। দেশে খাদ্যাভাব যখন ছিল, তখন আখচাষ বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্পসময়ে চাষ করা যায় এমন ফসল চাষ করে বেশি আয় করার ফলে ক্রমশ আখ চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

এছাড়াও অন্যান্য ফসলের সাথে আখের মূল্য না বাড়ার কারণে কৃষক ভাইয়েরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের জমিতে আখের চাষ করা হচ্ছে। ফলে আখের ফলন দিনকে দিন কমেই যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সার্বিকভাবে দেশের চিনি শিল্পের ওপরে। তাই আখ ফসলকে এ বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য এবং আখ চাষে কৃষকদের আরো বেশি আগ্রহী করে তুলতে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও সহায়তাকল্পে ‘আখের সাথে সাথীফসল হিসাবে ডাল, মসলা ও সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প’ নামে ৩ বছর মেয়াদি প্রকল্প শুরুহয়েছে।

দেশের ১৫টি সুগার মিল এলাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আখ চাষকে লাভজনক করতে আখের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে মটরশুঁটি, মসুর, মাসকালাই, খেসাড়ী, ছোলা ও মুগ; মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ ও রসুন; এবং সবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে আলু, ফুলকপি, টমেটো চাষ করা হচ্ছে। রাজশাহী সুগারমিল এলাকার কৃষকের মাঠে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় আখের সাথে সাথীফসল চাষ কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করেছে।

আখের সঙ্গে সাথী ফসল চাষের কারণ সম্পর্কে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী মো. রাশেদুল ইসলাম পাভেলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- আখের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে ডালজাতীয়, মসলাজাতীয় ও সবজি জাতীয় ফসলগুলো আলাদা জমি ছাড়াই বিনা সেচে বৃষ্টিনির্ভর অবস্থায় চাষ করা যায়, যা এককভাবে আখ চাষের চেয়ে অনেক লাভজনক। সাথী ফসল পরিচর্যার সময় আখের আংশিক আন্তঃ পরিচর্যার কাজও হয়ে যায়। ডাল ফসলের গাছ ছোট, পাতা কম সে জন্য আখের সঙ্গে এর পুষ্টি এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রতিযোগিতা কম। সাথী ফসল হিসেবে ডালজাতীয় ফসল চাষে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়।

এ ছাড়াও আখের সঙ্গে সাথীফসল হিসেবে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করলে অতি অল্প সময়ে অতিরিক্ত একটি ফসল পাওয়া যায়। সাথীফসল চাষে জমির ব্যবহার বৃদ্ধি ও জাতীয় উৎপাদন বেড়ে যায়। পেঁয়াজ ও রসুনের গাছ ছোট, পাতা কম ও সরু এবং গুচ্ছমূলের পরিধি সীমিত হওয়ায়, আখের সঙ্গে এদের মাটি থেকে পুষ্টি নিতে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আখ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সাথী ফসল থেকে আংশিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। এছাড়াও পেঁয়াজ ও রসুনের পাতায় তীব্র ঝাঁজ থাকায় সাথীফসল হিসেবে চাষ করলে আখে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। আখের সঙ্গে সাথীফসল চাষ করলে জমিতে আগাছা কম হয় ফলে মূল ফসলের ফলন অনেকাংশে বেড়ে যায়।

রাজশাহী চারঘাট উপজেলার ধর্মহাটা গ্রামের প্রকল্পের সুবিধাভোগী কৃষক মো. আজিজুল হকের সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি প্রকল্প থেকে আখ ও সাথীফসল চাষের যাবতীয় খরচাদি পেয়েছেন। তিনি এই প্রকল্প থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন। তিনি ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সাথে প্রথম সাথীফসল ফুলকপি চাষ করে প্রায় ৭২ হাজার টাকার ফুলকপি বিক্রি করেছেন। ফুলকপি উত্তোলনের পর তিনি ২য় সাথীফসল মুগডাল থেকেও ২.৫ মণ মুগডাল পেয়েছেন।

তিনি ১ বিঘা বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাশ) জাতের ৮৩০০ টি চিবিয়ে আখ ১.১৭ লক্ষ টাকায় বিক্রি করেছেন। একই উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের সুবিধাভোগী আরেক কৃষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরেই আখ চাষ করে আসছি কিন্তু এত পরিমাণ সহায়তা কোনদিনও পাইনি। তিনি ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সাথে ১ম সাথীফসল মসুর চাষ করে প্রায় ৬ মণ মসুর পেয়েছেন যার বাজার মূল্য বিশ হাজার টাকা। এছাড়াও তিনি ১ বিঘা জমি থেকে প্রায় ১২ টন আখ (বিএসআরআই আখ ৪৫ জাতের) বিক্রি করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এছাড়াও রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার উপকারভোগী কৃষক মো. নাদের আলী, মোঃ মেছের উদ্দিন, মো. আকবর প্রামাণিক, মো. মজিদ আলী ও মো. সাজেদুর বলেন আখের সাথে সাথীফলক অত্যন্ত লাভজনক প্রযুক্তি তাই এবছরে আখের আবাদ আরো বৃদ্ধি করবেন। এমন প্রকল্প চলমান থাকলে অনেকেই আখ চাষে উদ্বুদ্ধ ও আকৃষ্ট হবেন এবং আখ ও সাথীফসলের আবাদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।