খাবার সমাজের সম্পদ, এটা অপচয়ের অধিকার কারো নেই


মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। সীমাহীন চাহিদার মাঝে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাÑ এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। আমরা এই মৌলিক চাহিদাগুলোকে আবার যদি গুরুত্বের ক্রমানুসারে সাজাই তবে নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম যে নামটি আসবে তা হচ্ছে খাদ্য। অন্য চারটি মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে, পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকা কঠিন হয় বটে, তবে অসম্ভব হয় না। কিন্তু খাদ্য ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব এক কথায় অসম্ভব।

খাদ্যের সাথে মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত থাকায় সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত মানুষের সকল কর্মযজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে খাদ্য যোগাড় করা। পেটের ক্ষুধা মেটাতে অনেককে সকাল-সন্ধ্যা অমানবিক পরিশ্রম করতে হয়। অনেক পেশার মানুষ সরাসরি খাদ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণের সাথে জড়িত থাকে না কিন্তু তাদের অর্থ উপার্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নিজের ও পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের সংস্থান। আর পৃথিবীর এক বিরাট সংখ্যক মানুষ, যাদেরকে আমরা কৃষক নামে অভিহিত করি, তারাঅবিরত পরিশ্রম করে চলেছে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্য।

দুনিয়ার সকল কৃষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎপাদিত মোট খাদ্যের পরিমাণ বর্তমান পৃথিবীর সব মানুষের মোট চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। অবশ্য বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত এ খাবারের সবটুকুই শুধু মানুষের জন্য উৎপাদন করা হয় তেমনটা নয়। এর একটা বড় অংশ পশুখাদ্য ও বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য প্রয়োজনেও চলে যায়কিছু পরিমাণ খাদ্য। তারপরও যে পরিমাণ খাবার অবশিষ্ট থাকেতা পৃথিবীতে বসবাসরত ৭৮৩ কোটি মানুষের মোট চাহিদার তুলনায়ও বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ^ খাদ্য কর্মসূচির হিসাব অনুসারে, বিশে^র ৮২ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে। প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি শিশুসহ ২৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু ক্ষুধা ও ক্ষুধা সম্পর্কিত সমস্যার কারণে। ২১ শতকে দাঁড়িয়েও ক্ষুধা এখনও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা।

বিগত ২ দশকে জনসংখ্যাবৃদ্ধি, আয় বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের খাদ্য বৈচিত্র্যের কারণে খাদ্য চাহিদা অনেকটা বেড়ে গেছে।এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ফসলহানি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এখনও ক্ষুধার প্রধান কারণ খাদ্যের অপচয়।

বিশ্বপর্যায়ে উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অপচয় হয়। খাদ্য অপচয়ের দুটি ধরণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে হয় ফুড লস বা খাদ্য হারানো এবং শেষ প্রান্তে হয় ফুড ওয়েস্ট বা খাদ্য অপচয়। বিভিন্ন খাদ্য (শস্যদানা, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ইত্যাদি) উৎপাদনের পর বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে যে অপচয় হয় সেটি ফুড লস, পক্ষান্তরে বিপণনের পর থেকে সে খাদ্য যদি প্লেটে না আসে অর্থাৎ খাওয়ার জন্য প্রস্তুত না হয় বা প্লেটে আসার পরও নষ্ট হয় তবে সেটি হচ্ছে ফুড ওয়েস্ট বা খাদ্য অপচয়।

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউনেপের খাদ্য অপচয় সূচক (২০২১) অনুসারে ২০১৯ সালে বিশ্বে গৃহস্থালি বা পরিবার পর্যায়ে বছরে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় হয়েছে ৭৪ কেজি। এটা খাওয়ার উপযুক্ত খাদ্য অপচয়ের ৬১%। এসময় খাদ্য বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো ২৬% (হোটেল, রেস্তোরাঁ) এবং খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ১৩% খাবার অপচয় করেছে।এ তিন পর্যায়ে যে খাবার অপচয় হয়েছে তা খাওয়ার উপযুক্ত মোট খাবারের ১৭% এবং এর মোট পরিমাণ ৯৩ কোটি টন। অপচয় হওয়া এ খাদ্যের যদি মাত্র চার ভাগের এক ভাগ রক্ষা করা যায়, তবে তা দিয়ে বিশ্বের পর্যাপ্ত খাদ্যহীন সকল মানুষের সারা বছরের খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব ।

গৃহস্থালি পর্যায়ে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় বৈশি^কহারের চেয়ে কম হলেও এখানে যে পরিমাণ অপচয় হচ্ছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের। ২০২১ সালের ইউনেপের প্রতিবেদন অনুসারেপরিবার পর্যায়ে বাংলাদেশে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় বার্ষিক ৬৫ কেজি। এ রিপোর্ট অনুসারে এখানে বছরে ১ কোটি ৬ লক্ষ টন খাদ্য নষ্ট হচ্ছে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়েখাদ্য বেশি নষ্ট হচ্ছে, তবে বিলাসিতা ও অসচেতনতার কারণে অপচয়ও কিন্তু কম নয়। শহরে তো বটেই, আমাদের গ্রামগুলোতেও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবার অপচয় হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশে গৃহস্থালিতে চালের অপচয় ৫.৫%। এ অপচয় রোধ করলে ৯৫ লক্ষ লোকের সারা বছরের ভাতের চাহিদা পূরণ সম্ভব। আরশুধু খাবার টেবিলের অপচয়(২.৫%) রোধের মাধ্যমে ৪২ লাখ মানুষের বছরের ভাতের চাহিদা মিটতো। সবজি, ফল, মাছ, মাংসসহ অন্যান্য খাদ্যের অপচয়ও হচ্ছে এভাবে।

সামাজিক নানা আয়োজনে আগের চেয়ে খাবারের পদের সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি নির্দেশ করে। কিন্তু এ খাবারের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে ভাগাড়ে। ডাস্টবিন থেকে খাবার সংগ্রহের চিত্রএখনও কিন্তু বিরল নয়।

খাদ্য অপচয়ে শুধু খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে তা নয় বরং এর মাধ্যমে আমরা শ্রম, বিনিয়োগ, পানি, সার, বীজ, ভূমি, জ¦ালানি, পরিবহনের মত মূল্যবান সম্পদ অপচয় করি। এ অপচয়ের কারণে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে পরিবেশের উপর তৈরি হচ্ছে তীব্র চাপ।খাদ্য অপচয় মানে ক্ষুধার্তের খাদ্য কেড়ে নিয়ে তার মৃত্যুর দায়ের অংশীদার হওয়া। খাদ্য নষ্ট করা মানে খাদ্যের মূল্য বাড়িয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুর্ভোগকে তরান্বিত করা। আর টাকা থাকলেই যে খাদ্যকেনা সম্ভব হয় না, সে অভিজ্ঞতা বিশ^ কিন্তু আগেই অর্জন করেছে।

পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেরও খাদ্য অপচয় কিন্তু আমাদের চাইতে কম।সবচেয়ে ভালো উদাহরণ রাশিয়া। তাদের পরিবার পর্যায়ে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় বছরে মাত্র ৩৩ কেজি। অস্ট্রিয়াতে ৩৯ কেজি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও আমাদের প্রতিবেশী ভারতে এ হার ৫০ কেজি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানেও খাদ্য অপচয় আমাদের চেয়ে কম।আমাদের অভ্যাসে কিছু ছোট পরিবর্তন আনলেই কিন্তু আমরা রক্ষা করতে পারি বিপুল পরিমাণ খাদ্য। খাদ্য অপচয় রোধে আমরা নিচের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে পারি।

১. কিনুন যতটা আপনার প্রয়োজন। চাহিদার তুলনায় বেশি খাবার কেনাকাটা করবেন না।
২.বিভিন্ন প্রকার খাবার সংরক্ষণের খুব সাশ্রয়ী ও সহজ পদ্ধতি রয়েছে। আপনার ব্যবহৃত খাবার সংরক্ষণের পদ্ধতি শিখে নিন।
৩. উদ্বৃত্ত খাবার সংরক্ষণ করুন অর্থাৎ খেয়ে ফেলুন।
৪.নিয়মিত খাবার উদ্বৃত্ত থাকলে একদিন রান্নানা করে ফ্রিজে জমা খাবার খান।
৫.বেঁচে যাওয়া খাবার প্যাকেটে করে নিয়ে যান। অতিরিক্ত খাবার অতিথিদের প্যাকেট করে দিন।
৬.খাবারের অংশের বিকল্প ব্যবহার করুন।
৭.পুরাতন পণ্যগুলো ফ্রিজ বা আলমারির সামনে এবং নতুন পণ্য পিছনে রাখুন।
৮.এমন খাবার দান করুন যা অন্য ভাবে নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী, স্বেচ্ছাসেবী বা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি করুন।এ ক্ষেত্রেঅনলাইন যোগাযোগ কাজে লাগান।
৯.বাড়িতে খাবারের ছোট অংশ নিন এবং রেস্টুরেন্টে বড় খাবার ভাগ করুন।
১০.দেখতে ভালো নয় বলে ফল, সবজি বা অন্য কোনো খাবার ফেলে দেবেন না। অদ্ভুত আকৃতির বা ক্ষত-বিক্ষত এসব পণ্যের স্বাদ কিন্তু একইরকম।
১১.“খাবার অপচয় করলে দ্বিগুণ দাম পরিশোধ করতে হবে”- বুফে পদ্ধতির রেস্টুরেন্টে এ নীতি চালু করুন।
১২.বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হতে চলা খাবার ছাড়মূল্যে বিক্রয় করতে পারেন।
১৩.অতিথি বা যে কারো পাতে জোর করে বেশি খাবার তুলে দেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
১৪.রাগ প্রকাশে প্লেটে খাবার থাকতে হাত ধোয়া বা প্লেটের খাবার রেখে উঠে পড়ার মত অগ্রহণযোগ্য কাজ থেকে বিরত থাকুন। খাদ্য অপচয় যে গর্হিত কাজ সেটাসন্তানদের শেখান।
১৫. কেনার সময় খাবারের মেয়াদ দেখার অভ্যাস করুন।

সত্যিকার অর্থেই খাদ্য অপচয় একপ্রকার অপরাধ।জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত, বৈশি^ক করোনা অতিমারি, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বিষয়গুলো বিশে^র খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, ২০২২ সালে বিশে^ খাদ্য উৎপাদন কমবে ২.১%। উক্ত পূর্বাভাস অনুসারে বাংলাদেশে ধান, গম ও দানাদার শস্যের উৎপাদন হ্রাস পাবে ০.৩% বা ২ লক্ষ টন। এ পরিমাণ খুব বেশি নয় কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে বড় ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভূক্ত করেছে।সম্প্রতি আমাদের অতি নিকটের শ্রীলঙ্কায়খাদ্যসংকটের বেহাল অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

বিশ্বের অনেক দেশে খাদ্য অপচয় রোধে শাস্তিমূলক আইন রয়েছে।টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের আওতায় বিশ^ নেতারাখুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তা পর্যায়ে মাথাপিছু বৈশ্বিক খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে একমত হয়েছেন।রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষ থেকে দেশকে রক্ষায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি অপচয় কমানোর উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। নিজের টাকায় খাবার কিনলেও সেখাবার নষ্ট করার অধিকার কারো নেই, কারণ খাবার সমাজের সম্পদ। খাবার ফেলে দেয়ার আগে কঙ্কালসার ওইসব মুখগুলো একবার কল্পনা করুন, এক মুঠো খাবারের আশায় যারা সুদীর্ঘ অপেক্ষারত।‘কখনও খাদ্য অপচয় করাবো না’-আসুন আমরা এ প্রতিজ্ঞা করি।

 

মোঃ তৌহিদুজ্জামান
উপপ্রধান তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী

 

– পিআইডি, রাজশাহী