প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষার বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়


প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষার বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়ঃ
‘‘প্রতিবন্ধী অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি জন্মগত ভাবে বা রোগাক্রান্ত হইয়া বা দূর্ঘটনায় আহত হইয়া বা অপচিকিসার বা অন্য কোন কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে বারসাম্যহীন এবং উক্ত রূপে বৈকল্য বা ভার সাম্যহীনতার ফলে স্থায়ী ভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমহীন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে অক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ হিসাব মতে উন্নত বা উন্নয়নশলি দেশের মোট জনসংখ্যার ১০% কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধী এই তত্ত্ব মতে এবং দেশের বিভিন্ন জরিপ থেকে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লক্ষ প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে যাদের মাত্র ২.৬ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে গমন করে। বাকিরা ¯্রফে নিরক্ষর।

অবশ্য আমার কথা সরকার দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী এ সকল প্রতিবন্ধি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন এর চেষ্টা করছে। এখানে সকল শিশু বলতে সাধারণ শিশুদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধি শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সে যাই হোক এই সকল শিশুদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হলে এবং প্রতিবন্ধি শিশুর শিক্ষার বাস্তবায়ন করতে হলে আমার যা করতে হবে তা হলÑ ১। নীতি পরিবর্তন; ২। প্রতিবন্ধি শিশু চিহ্নিতকরণ; ৩। তাদের শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ তৈরী করা; ৪। সমাজের সকলকে প্রতিবন্ধি শিশুদের শিক্ষা এবং এদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা।

প্রতিবন্ধি শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরী। প্রতিবন্ধি শিশুদের শিক্ষার উপযোগী শিক্ষণ পদ্ধতি প্রবর্তন। অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা কারীকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন ও সহজীকর। চার ধরনের প্রতিবন্ধিÑ ১। শারীরিক প্রতিবন্ধি; ২। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি; ৩। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধি ও ৪। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি যারা সহনীয় মাত্রায় আছে তাদেরকে আমরা একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার মাদ্যমে মূল ধারায় নিয়ে আসতে পারি। শারীরিক প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের অন্যান্য প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীর তুলনায় কম শ্রম ও স্বল্প পরিমাণ সহায়তাদানের মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ করা যাবে। যেমনÑ সমস্যা অনুযায়ী সহায়ক উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।

উপকরণ ব্যবহারের জন্য বিদ্যালয়ের গমন পথ উপযোগী করে তৈরী করা, বিদ্যালয়ে র‌্যম্প তৈরী, শ্রেণীকক্ষে প্রসস্ত দরজা এবং যথাসম্ভব বাড়ীর কাছাকাছি বিদ্যালয়ে ভর্তি করা, শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পরিবার ও সহপাঠিদের স্বতঃস্ফুর্ত সহায়তাদানের মনোভাব সৃষ্টি করা। শারীরিক প্রতিবন্ধির চাহিদা বিবেচনা করে তার উপযুক্ত স্থানে বসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সাধারণ বেঞ্চ বা চেয়ারের পরিবর্তে তার উপযোগী বিশেষ চেয়ার, টেবিল এর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

সম্ভব হলে শারীরিক প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীকে শ্রেণীকক্ষের দরজার কাছাকাছি এবং দেয়ালের সাইডে বসার সুযোগ করে দেওয়া, যাতে অন্য শিক্ষার্থীদের যাতায়াত পথে বাঁধার সৃষ্টি না হয় এবং শিক্ষার্থী তার সহায়ক উপকরণ নিরাপদ স্থানে রাখতে পারে। সহায়ক উপকরণ ব্যবহারকারী শারীরিক প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী আছে এমন শ্রেণীকক্ষের আসবাবপত্র গুলো সারিবদ্ধ ভাবে থাকবে এবং চলাচলের পথ প্রসস্ত থাকবে যাতে শিক্ষার্থী তার সহায়ক উপকরণ নিয়ে সহজেই চলাচল করতে পারে।

আংশিক ও সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণীকক্ষ উপযোগীকরণের কৌশল হতে পারে, সামনের সারিতে বসতে দেওয়া। শ্রেণীকক্ষে তার প্রয়োজন মত আলোর ব্যবস্থা করা বা জানালার কাছাকাছি বসতে দেওয়া। ব্ল্যাক বোর্ডের উপর পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা এবং বোর্ডটি যেন গাঢ় কালো থাকে তা নিশ্চিত করা, কোন বিষয়ের ছবি/চিত্র দেখার ক্ষেত্রে লোভিশন শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী সেগুলো বড় করে আঁকা এবং উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার নিশ্চিত করা, ব্ল্যাক বোর্ডের লেখা যেন পরিষ্কার বড় বড় স্পষ্ট হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং লিখবে সাথে সাথে মুখেও বলতে হবে।

মোট দাগযুক্ত ও গাঢ় কালির কলম বা পেন্সিল ব্যবহার করতে দেয়া বড় অক্ষরের ছাপা বইয়ের ব্যবস্থা করা লোভিশন শিশুটির জন্য। উজ্জ্বল ও মোটা দাগের লাইন টানা খাতা ব্যবহার করতে দেয়া, কোন বিষয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীর নাম করে ডাকা, তাদের ক্ষেত্রে ইশারা ইঙ্গিত ব্যবহার না করা।

শিক্ষার্থী যদি ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে সে ক্ষেত্রে কোন বিষয় লেখা ও পড়ার জন্য কিছুটা সময় অন্যদের তুলনায় বেশি দেয়া, একাধিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী এক সঙ্গে না বসিয়ে চক্ষুমান সহপাঠিদের সংগে মিলেমিশে বসান, দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী মনে কষ্ট পায় অথবা তাদের ক্ষেত্রে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বোধক কোন গল্প অভিজ্ঞতা, কৌতুক ইত্যাদি হতে বিরত থাকা।

শ্রেণীকক্ষের আসবাবপত্র গুলো সারিবদ্ধভাবে গুছিয়ে রাখা আছে কিনা তা ক্লাসে শুরু করার পূর্বেই লক্ষ করা ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীর চলাচলের জন্য নিরাপদ করা, শ্রেণীকক্ষের আকার আয়তন সম্পর্কে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্পর্শের মাধ্যমে নিখুঁত ধারণা দেয়া। শ্রেণীকক্ষের আসবাবপত্রের কণাগুলো যাতে সূঁচালো না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর আসা যাক বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধি শিশুদের শেখানোর কৌশল কি হতে পারে। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধি শিশুদেরকে প্রথম বা দ্বিতীয় সারিতে বসাতে হবে, শ্রেণীর আলোক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে শিক্ষার্থী শিক্ষকের মুখমন্ডল স্পষ্টভাবে দেখতে পারে, কারণ শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধি শিমু কথা বলার সময় ঠোটের নড়াচড়া দেখে ভাল বুঝতে পারে, খেয়াল রাখতে হবে যাতে মুখ ঢেকে বা মুখ ঘুরিয়ে কথা বলা না হয়, এছাড়া শিক্ষককে কিচু ইশারার ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ জেনে নিতে হবে।

শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলার আগে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি এবং স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করতে হবে, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্য কারিকুলাম কিছুটা নমনীয় হওয়া উচিত। শ্রবণ প্রতিবন্ধি শিমু যারা হিযারিং এইড ব্যবহারকারী শিমুকে শিক্ষকের থেকে ২ মিটার দূরত্বের মধ্যে বসতে দিতে হবে। শ্রেণিতে অতিরিক্ত শব্দ যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শব্দের প্রতিধ্বনি যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হিয়ারিং এইচ পরিহিত শিশুদের সংগে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে হবে, উচ্চস্বরে কথা বলার প্রয়োজন নেই।

যারা সহনীয় মানার বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশু তাদের বিদ্যালয়ে সহায়তা করার কয়েকটি কৌশল হতে পারে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশুকে সামনের সারিতে বসাতে হবে। সব সময় লক্ষ রাখতে হবে সে যেন শ্রেণীকক্ষের দুষ্ট ছেলে-মেয়েদের সাথে না বসে। যারা তাকে বিরক্ত করতে পারে, তাকে পড়াশুনায় ভাল এমন একটি শিশুর পাশে বসানো যেতে পারে। যাদের বিশেষ বন্ধু হিসাবে অভিহিত করা যায় এবং বছর শেষে এই বিশেষ বন্ধুকে সম্মানিত করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশুটির সংগে কথা বলার সময় সামনা সামনি দাড়াঁন।

ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে আস্তে আস্তে কথা বলতে হবে। তাদেরকে জটিল ধরনের কোন প্রশ্ন করা উচিত নয় এবং উত্তরের জন্য বেশী সময় প্রদান করা এবং তাদেরকে শেখার জন্য পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিত করা উচিত। আর এ সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যেটি প্রয়োজন তা হলো সচেতনতা সৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন। তাহলেই আমরা প্রতিবন্ধি শিশুর শিক্ষার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারব।

 

লেখক:
মো. সোহেল রানা
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
দুর্গাপুর, রাজশাহী।