মনোজিৎ কুমার মজুমদারঃ ক্লান্তি দূর করে শরীর ও মনকে সতেজ রাখতে চায়ের জুড়ি মেলা ভার। চা গাছের দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি থেকে তৈরি হয় সুপেয় চা। আড্ডা কিংবা একাকিত্বে চা আমাদের সব অনুভূতির সঙ্গী। অনেকেরই সকালটা শুরু হয় এক কাপ উষ্ণ চা দিয়ে।
চা একটি উপকারী পানীয়। চিকিৎসকদের মতে, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে চা। চায়ের মধ্যে পটাশিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা শরীর ও মন উৎফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। চায়ের সাথে লেবু, আদা, লবঙ্গ মিশিয়ে পান করলে ঠান্ডা, কাশি, গলা ব্যথা উপশম হয়। তবে গ্রিন টি (সবুজ চা) তুলনামূলকভাবে বেশি উপকারী, কারণ এই চা ভাপে সেদ্ধ করে শুকিয়ে তৈরি করা হয়।
চা বাগানের নাম শুনলেই প্রথমে মনে আসে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের নাম। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান মালনীছড়া। এটি ১৮৫৪ সালে লর্ড হার্ডসন ১ হাজার ৫ শত একর জমির উপর এই বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন। মালনীছড়া চা বাগানেই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের আবাদ শুরু হয়। মূলত তখন থেকেই চা এ অঞ্চলে একটি কৃষি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে তারও আগে ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের যেখানে বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব অবস্থিত সেই স্থানে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা গাছ রোপন করা হয়। এটি কুন্ডদের চা বাগান নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়ায় বাগানটি পরিত্যক্ত হয়।
সিলেটকে বলা হয় ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির’ দেশ। এক সময় চা বাগান বলতে শুধু সিলেটকেই বুঝানো হতো। সময়ের পরিক্রমায় দেশের অন্যান্য জেলাতেও চা বাগান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ টি বোর্ডের সর্বশেষ রিপোর্ট আনুযায়ী, দেশে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৬৮টি। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, চট্টগ্রামে ২১টি, সিলেটে ১৯টি, পঞ্চগড়ে ৮টি, রাঙ্গামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁও ও খাগড়াছড়িতে ১টি করে চা বাগান রয়েছে। চা উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে নবম। প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চা শিল্পের সাথে জড়িত। চা শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে বহু বছর ধরে। জিডিপিতে চা খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ২৫টির বেশি দেশে।
চা উৎপাদনে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের চা শ্রমিক বলা হয়। দেশে চা শ্রমিকের ৭৫ ভাগই নারী। সবুজ চা পাতার সঙ্গে নারী শ্রমিকের সম্পর্ক বহুকালের। দুটি পাতা একটি কুঁড়ি উঠে আসে নারীদের হাত স্পর্শ করে। চা- পাতা তোলার কাজে নারী শ্রমিকরাই বেশি পারদর্শী। তারা পুরুষদের তুলনায় বেশি দক্ষ এবং কর্মঠ। নারী শ্রমিকরা চা শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছে। পুরুষ শ্রমিকরা বাগান রক্ষণাবেক্ষণ, চারা রোপণ, বাগানের নিরাপত্তা প্রদানসহ অন্যান্য কাজের সাথেই বেশি জড়িত থাকে। নারী চা শ্রমিকদের অধিকাংশই দলিত আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তাদের শ্রম, মর্যাদা এবং অধিকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোতে উপেক্ষিত থেকে গেছে। চা শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-বৃষ্টি
কোনো কিছুই তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে তারা কাজ করে থাকে। দুপুরে খাবারের জন্য তাদের ৩০ মিনিট বিরতি দেয়া হয়। তাদের মজুরি অত্যন্ত সীমিত, মানসম্মত কর্মপরিবেশের অভাব এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও তারা প্রায় বঞ্চিত। নারীর ঘামে-শ্রমেই আজ চা শিল্প সুুপ্রতিষ্ঠিত। যে নারী শ্রমিকরা চা শিল্পকে অধিষ্ঠিত করেছে মর্যাদার আসনে, তাদের অধিকার নিশ্চিত করা সময়ের দাবী।
২০০৫ সালে চা শ্রমিকদের মজুরি ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রথম দফায় ৩২ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৪৮ টাকা করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রয়ে ২০১২ সালে ৬৫ টাকা, ২০১৫ সালে ৭৯ টাকায়, ২০১৭ সালে ৮৫ টাকা, ২০১৯ সালে ১০২ টাকা এবং ২০২০ সালে ১২০ টাকা করা হয়। ২০২২ সালে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পর সরকার মজুরি বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করে। ২০২৩ সালে নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ হওয়ার পর ২০২৪ সাল থেকে চা শ্রমিকদের ১৭০ টাকা মজুরির সাথে বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ হচ্ছে। চা শ্রমিকদের বর্তমান দৈনিক মজুরি ১৭৮ টাকা। এর সাথে তাদের বছরে দুটি উৎসব বোনাস বাবদ দেওয়া হয় ৪ হাজার ২ শত ৫০ টাকা। একই সঙ্গে চা শ্রমিকরা প্রতি সপ্তাহে ৩ দশমিক ৩ কেজি ভর্তুকি মূল্যে আটা বা চাল পেয়ে থাকে (প্রতি কেজি ২ টাকা হারে)। বাইরে থেকে আসা চা শ্রমিকদের জন্য বাগানে বাসস্থান, শিক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধাসহ যে সব সুবিধাগুলো তারা পাচ্ছে, তা বর্তমান বাস্তবতায় যথেষ্ট কম বলে চা শ্রমিকদের দাবী। আবার পুরুষ এবং নারী চা শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্যের অভিযোগও রয়েছে। অনেক বাগান মালিক শ্রমিকদের এই সামান্য মজুরিও নিয়মিত পরিশোধ করে না। এক সপ্তাহ মজুরি দিলে পরের সপ্তাহ বকেয়া রাখে। এ অবস্থায় তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। চা শ্রমিক সংগঠন নতুন মজুরি কাঠামোকে অমানবিক ও বৈষম্যমূলক বলে
মন্তব্য করেছে। বাংলাদেশের সমপর্যায়ের চা উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর মজুরির সাথে তুলনা করলে এ মন্তব্যকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। বাংলাদেশের একজন শ্রমিক যখন দৈনিক ১৭৮ টাকা মজুরি পাচ্ছে তখন শ্রীলংকায় এ মজুরি ৫৫০ টাকা, কেনিয়া ৪৮৩ টাকা এবং ভারতে ২৫৬ টাকা। উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে সরকার এবং মালিক পক্ষের একযোগে কাজ করা দরকার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং বাগান মালিক পক্ষ চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বছরে ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধি, উৎসব ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, পানি ও
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করেছে। এ উদ্যোগগুলো চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।
বাংলাদেশে চা শিল্পের ইতিহাস ১৮৫ বছরের। সুদীর্ঘ এ পথচলায় দেশের চা শিল্প এগিয়েছে বহুদূর। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে শ্রমিকেরা চা শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অবদান রেখে চলেছে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হওয়া দরকার। উপযুক্ত মজুরি, নিরাপদ ও মানবিক কর্মপরিবেশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসনের সুযোগ বৃদ্ধি করা গেলে তাদের দক্ষ শ্রমশক্তি হিসেবে গড়ে উঠার সম্ভবনা অনেকখানি বেড়ে যাবে।
-০০-
(পিআইডি ফিচার রাজশাহী) লেখক: মনোজিৎ কুমার মজুমদার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।