এ.এস. সুমন, স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ ১৫ বছর পর শনিবার রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে জেলা ও মহানগর জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
গত শনিবার (১৮-০১-২০২৫ইং) রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে জেলা ও মহানগর জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে জামাতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, কোরআনের শাসন কায়েমের মাধ্যমে একটি মানবিক বাংলাদেশে গড়তে চাই। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মামলা বাণিজ্য করা থেকে বিরত থাকুন। যারা এসব করছেন, বিনয়ের সাথে বলি এগুলো বন্ধ করেন। তবে যদি আমাদের এই বিনয়ী অনুরোধ কেউ না শোনে, তাহলে তাদের আমরা বলছি, আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
কর্মী সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন জেলা আমীর ড. কেরামত আলী। মহানগর সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মন্ডল, সহকারী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ শাহাদত হোসাইন ও জেলা সেক্রেটারি গোলাম মূর্তুজার যৌথ পরিচালনায় সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও রাজশাহাী অঞ্চল পরিচালক অধ্যক্ষ মো. সাহাবুদ্দিন ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নূরুল ইসলাম বুলবুল।
জামায়াতের আমীর সামনের উপস্থিতির কাছে জানতে চান, আমি আশা করি রাজশাহীতে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখের পর আর চাঁদাবাজি হয় না। এখানকার মানুষ ভদ্র, এখানকার মানুষ বিনয়ী, এখানকার মানুষ কেউ চাঁদাবাজি করে না। মাঠ থেকে জবাব আসে না চাঁদাবাজি করে। জামায়াতের আমীর প্রশ্ন করেন এখানেও চাঁদাবাজি হয়! মাঠ দখল হয় ? হাটবাজার? বালু মহাল জলমহাল বিভিন্ন যানবাহনের স্ট্যান্ড? সবগুলোতে এখনও দখলদারি হয়? মাঠ থেকে উত্তর আসে হয়। তাহলে এগুলো কি শহীদদের প্রতি ভালবাসা? এটা কি শহীদদের প্রতি সম্মান?
আমীরে জামায়াত তাদের প্রতি অনুরোধ করে বলেন, একাজটা যারা করেন বিনয়ের সাথে অনুরোধ করছি এ কাজটা ছেড়ে দেন। দয়া করে এ কাজটা করবেন না। আমাদের শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে। মানবতা অপমানিত হবে, লাঞ্ছিত হবে। বন্ধু একাজটা ছেড়ে দেন। আল্লার ওয়াস্তে একাজগুলো ছেড়ে দেন। অফিস আদালতে যারা ঘুস বাণিজ্য করেন, আবার মামলা বাণিজ্য অনেকে করেন, তাদের আন্তরিক অনুরোধ, ভাই একাজগুলো করিয়েন না। আমাদের শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে। আর আমাদের জীবন্ত সন্তানেরা যারা শহীদ হওয়ার নিয়ত করে ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় সেদিন লাখো লাখো কোটি কোটি সন্তান নেমেছিল। তারা অন্তরে বড় কষ্ট পাবে। তাদেরকে কষ্ট দিবেন না মেহেরবানী করে। তবে যদি আমাদের বিনয়ী অনুরোধ না মানেন, তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত, যুদ্ধ আমাদের শেষ হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের সন্তানেরা স্লোগান দিচ্ছে এখনো “আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ”। তিনি আবার মাঠের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ’, মাঠ থেকে সম্মিলিত জবাব আসে ‘শেষ হয়নি যুদ্ধ’। এ লড়াই চলবেই ইনশা আল্লাহ। যতক্ষণ না ইনসাফ এই জমিনে কায়েম হয়। ইনসাফ কায়েমের জ্ঞান একমাত্র আল কুরআন দিতে পারে। আর কিছুই দিতে পারে না। এই কুরআনের শাসন সকল ধর্মের সকল দলের, সকল বর্ণের মানুষের জন্য একমাত্র ইজ্জতের গ্যারান্টি। কুরআনের শাসন কায়েমের মধ্য দিয়েই আমরা একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই। দুর্নীতি এবং দুঃশাসনমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই।
তিনি অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মান এবং ত্যাগ স্বীকার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, আমরা এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিবো না। বিশ্রাম নেওয়ার কোন সময় আমাদের নাই। এজীবন খুব ছোট, কাজ অনেক বড়। উপস্থিত কর্মীদের দেশে কুরআনের রাজ কায়েমে কাজ করার আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর বলেন, তারা মনে করেছিল নিজেরাই সার্বভৌম। সার্বভৌম মানে সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনি প্রশ্ন রাখেন এত ক্ষমতার মালিকতো দেশ ছেড়ে পালালেন কেন? সেই ক্ষমতার দাপটে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করতেন। আপনাদের পরাজয় এবং পলায়ন প্রমাণ করেছে, সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মোমেনরা দুনিয়ায় কারো কাছে মাথা নত করে না। এজন্য গত সাড়ে ১৫টি বছর বিশেষ করে আলেম-ওলামা, মোমেন-মোমেনাত, ওফাজ, আইতাব এদের ওপর বিগত সরকার তান্ডব চালিয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামীর দুইজন আমীর, একজন সেক্রেটারি জেনারেল, তিনজন নায়েবে আমীর, দুইজন অ্যাসিস্ট্যান্ড সেক্রেটারি জেনারেল এবং একজন নির্বাহী পরিষদ সদস্যসহ ১১ জন দায়িত্বশীল নেতাকে আমাদের বুক থেকে কেড়ে নিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ যারা করেছে, শত শত আমাদের সহকর্মীকে তারা খুন করেছে। অসংখ্য ভাইবোনকে গুম করেছে। পঙ্গু করেছে, আহত করেছে। তাদের চাকরি কেড়ে নিয়েছে। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে।
তিনি দেখতে চান কর্মী সম্মেলনে যারা উপস্থিত, তাদের মধ্যে কারা অন্তত একবার হলেও জেলে গিয়েছেন? দেখা যায় মাঠে বিপুল সংখ্যক মানুষ হাত তোলেন। মাঠে উপস্থিত অধিকাংশ লোকজনকেই জেল খাটতে হয়েছে। তিনি মঞ্চে বসে থাকা নেতাদের ইঙ্গিত করে দেখান যে, এখানে বসে থাকা সবাই জেল খেটেছেন। তারা কি চুরি ডাকাতি করেছিলেন? মানুষ খুন করেছেন, গুপ্ত হত্যা করেছেন? উত্তর আসে ‘না’।
তৌহিদবাদী একদল লোক আরবের নাজরানে ছিল। মুশরিকরা তাদের আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিল। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের বলা হয় ‘আসহাবুল উখদুত’। আাল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। হাজার বছরের স্মৃতি এখনো সেই এলাকা বহন করে চলছে। সেখানে দেখলাম তাদের হাড়গোড় ও দেহের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। স্বৈরশাসকরা বলেছিল এক আল্লাহ মানলে চলবে না। অমুক অমুককেও ইলাহ মানতে হবে। তারা বলেছিল না। আল্লাহ এবং ইলাহ একজনকেই মানবো দ্বিতীয় কাউকে স্বীকার করবো না। এজন্যই তাদের ওপর ঝাল মিটিয়েছিল। যারা ঝাল মিটিয়েছিল তারা ইতিহাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। যাদের আগুনে পুড়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের আল্লাহ কবুল করেছেন শহীদ হিসেবে। তিনি বাংলাদেশেও দ্বীনের জন্য, আল্লাহর জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কবুল করার দোয়া করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, কী দোষ ছিল তাদের? তারা বলেছিল, কোটা রাখেন কিন্তু সেটাকে যুক্তিসঙ্গত করে সংস্কার করেন। সহ্য করলো না। তাদের বিরুদ্ধে মুগরবাহিনী গুন্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিলো। মুগর বাহিনী বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ঢুকে ছেলেদেরতো পিটালো-ই, আমাদের কলিজার টুকরা মেয়েদেরও পিটালো। যাদের ওপর গুলী করলো তারা যেন মানুষ নয় বন জঙ্গলের পশু। কতগুলো আদম সন্তানকে যে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে; তার হিসাব দুনিার কেউ দিতে পারবে না।
কর্মী সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, পাবনা জেলা আমীর আবু তালেব মন্ডল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমীর আবু জার গিফারি, নাটোর জেলা আমীর ড. মীর নূরুল ইসলাম. নওগাঁ জেলা আমীর খন্দকার মো. আব্দুর রাকীব, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিস রাজশাহী মহানগর সভাপতি মুফতি মোহাম্মদ আবুল বাশার, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ রাজশাহীর আহ্বায়ক মাওলানা হাবিবুর রহমান কাসেমী।
স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর এডভোকেট আবু মোহাম্মদ সেলিম, রাজশাহী জেলা জেলা নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল খালেক, ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় শাখা সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, রাজশাহী মহানগর সভাপতি মো. শামীম উদ্দিন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নওসাজ জামান, জামায়াতের রাজশাহী মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাহববুল আহসান বুলবুল, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের মহানগর সভাপতি অধ্যাপক আবদুস সামাদ, রাজশাহী জেলা সহকারী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নাজমুল হক, জেলার শ্রমিক কল্যাণ সভাপতি অধ্যাপক কামরুজ্জামান, রাজশাহী মহানগরী সাংগঠনিক সেক্রেটারি জসিম উদ্দিন সরকার, শিবিরের রাজশাহী জেলা পূর্ব সভপতি মো. রুবেল আলী, রাজশাহী জেলা পশ্চিমের সভাপতি মো. ইলিয়াস হোসেন, রাজশাহী বিভাগের উলামা সেক্রেটারি মাওলানা মো. রুহুল আমিন, রাজশাহী জেলা মাদরাসা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি মাওলানা এফ.এম ইসমাইল আলম, জামায়াতের রাজশাহী মহানগর যুব বিভাগীয় সেক্রেটারি সালাহ উদ্দিন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন রাজশাহী জেলা আমীর অধ্যাপক আব্দুল খালেক। উদ্বোধন করেন জুলাই বিপ্লবের রাজশাহীর শহীদ সাকিব আনজুমের গর্বিত পিতা মাইনুল হক। এর আগে মাওলানা আরিফুল ইসলামের অর্থসহ কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রত্যয় শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যরা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, রাজশাহীতে এসে জানতে পারলাম কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা কোল্ড সংরক্ষণের খরচ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। হুঁশিয়ার করে বলতে চাই দেশের মানুষ আর কোন জুলুমকারীকে সহ্য করবে না। এক জুলুমবাজ পালিয়েছে। নতুন কোন জালেম সামনে এলে তাদেরও তাড়িয়ে দেবো। তিনি আরও বলেন দেশ থেকে জালেম পালিয়েছে, জুলুম পালায়নি। জুলুম থেকে বাঁচতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ফ্যাসিবাদীরা কারো কথা বলতে দেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে কেউ বললেই খুন গুম করেছে, আস্তে করে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা বিচারব্যবস্থা শিক্ষাব্যবস্থাসহ সবকিছু ধ্বংস করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রতিশোধ নিয়ে পালিয়েছে। এখন আমরা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে চাই। এজন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
অধ্যক্ষ মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, এদেশের মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে সব মতবাদ দেখা শেষ। এখন আল কুরআনের বাংলদেশ গড়তে হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সেই কাজটি করতে চাচ্ছে। যারা চুরি করছে, যারা ডাকাতি করছে, ধর্ষণের সেঞ্চুরি করছে। লুট করছে, তারা জানে, জামায়াতে ইসলামী যদি ক্ষমতায় আসে আমাদের হাত কাটা যাবে। এদেশ থেকে আমাদের পালাতে হবে। এই বিচারের ভয়ে তারা শত্রুতা করছে। আওয়ামী লীগের বানানো কাঠগড়াতেই তাদের বিচার হবে বলেও জানান তিনি।
নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমরা বাতিলের কাছে কখনো মাথা নত করবো না। এদেশের তরুণ সমাজ যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য রক্ত দিয়েছে সেই স্বপ্ন জামায়াতে ইসলামী দেখে। আমরা ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ চাই। এই বাংলাদেশ নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবো না। তিনি আগামী দিনে ইসলামের দাওয়াত প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। এমনকি রাজশাহী থেকে ইসলামের বিজয় শুরু হবে ইনশা আল্লাহ।
এরপর আমীরে জামায়াত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. কায়সার আহমেদ অডিটরিয়ামে পেশাজীবী সমাবেশ এবং মহিলা রুকন সম্মেলন ও ব্যবসায়ীদের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।