বগুড়া পৌরসভার মেয়রের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ


বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়া পৌরসভার বিগত আড়াই বছরে ৬০ কোটি টাকার তহবিল তছরুপ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পৌর মেয়র ও জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযোগের ভিত্তিতে বগুড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালককে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ৩ জুলাই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ দেয়। এর প্রেক্ষিতে ১৭ আগস্ট একই স্থানীয় সরকার বিভাগের (পৌর-১ শাখা) উপসচিব আবদুর রহমানের স্বাক্ষরিত পত্রে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তবে এ অভিযোগ উল্লেখিত বিষয়গুলো অস্বীকার ও ভিত্তিহীন দাবী করেছেন পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা। তিনি বলেন, ‘অভিযোগকারী এমএকে আজাদ নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এজন্য বগুড়া পৌরসভায় তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। পৌরসভায় অবৈধ কাজ করতে না পেরে মন্ত্রীর কাছে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।’

পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, পৌর মেয়র স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমতি ব্যতিরেকে পৌর ভবনের নক্সা পরিবর্তন করে গ্যারেজ ও ভবন ভেঙে ৭৫ লাখ ঘুষ নিয়ে মিডল্যান্ড ব্যাংকের উপ-শাখা স্থাপন করেন। জন্ম নিবন্ধন ফি ২৫ টাকা, ৫০ টাকা ও ১০০ টাকা। পৌরসভার কর্মরত রাজস্ব কর্মচারীর পরিবর্তে বিএনপি দলীয় ১০ জনকর্মীকে দিয়ে কাজটি করান। এছাড়া জন্ম নিবন্ধনের প্রায় কোটি টাকা সরকারি খাতে জমা না করে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে তহবিল থেকে মোট আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ উত্তোলন করে।

পৌরসভার নিম্নমান সহকারী আতিকুর রহমান ও তার স্ত্রী উপ-সহকারী প্রকৌশলী রোকসান পারভীন রেখা মেয়রের পালিত মেয়ের জামাইয়ের আত্মীয়। সেই সুবাদে তাদের ওপর প্রকৌশল শাখার ঠিকাদারি বিল, যানবাহন মেরামত ও নকশা দেখভালসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়াও মেয়রের নির্দেশনায় উপসহকারী প্রকৌশলী হুমায়ন কবির বিধিবহির্ভূতভাবে ই-জিপি টেন্ডারের মাধ্যমে মেয়রের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাজ পাইয়ে দেন। অনেক সময় কাজ না করেই টেন্ডারের বিল দেওয়া হয়। গত দুই বছরে কাজ না করে রাজস্ব উন্নয়ন ও প্রকল্পের তহবিল থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। মাঠপর্যায়ে এসব কাজের কোনো নমুনা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট, ড্রেনে জলাবদ্ধতার চিত্র দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যায়।

গত আড়াই বছরে বগুড়া পৌরসভায় প্রায় তিন হাজার ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। রাস্তার মাপ দ্বিগুণ দেখিয়ে বিল্ডিংয়ের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতি নকশায় ৫০ হাজার টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা উৎকোচ নেওয়া হয়। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে নকশা অনুমোদনের নথি পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা মিলবে। নকশা অনুমোদন দিয়ে মেয়র প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে শহরকে মৃত্যুকুপে পরিণত করেছেন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, পৌরসভার টাকায় বিএনপি কর্মীদের বেতন ভাতা প্রদান বাবদ প্রায় ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, আর্থিক সাহায্যের নামে বছরে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, বগুড়া পৌরসভার বসতবাড়ি, ভবন স্থাপনা অ্যাসেসমেন্ট কর নিরূপণে কমিটি আছে। অথচ তাদের নামমাত্র স্বাক্ষর করার ক্ষমতা দিয়ে মেয়র ইচ্ছামতো ৭৫ শতাংশ হ্রাস করেছেন। আদায়কালে আবার ৩০ শতাংশ রিবেট দিয়ে পৌরসভার আর্থিক ক্ষতি করে উল্টো নাগরিকদের কাছে উপরি হিসাবে ১৫ শতাংশ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মেয়র নিজের ছয়তলা বাড়ির অ্যাসেসমেন্ট কর নামমাত্র করে নিয়ে তার ভবনকে টিনশেড বাড়ি দেখিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদনহীন অবস্থায় স্থানীয় বিএনপির ১০ কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছে মেয়র। অথচ তাদেরকে বেতন ভাতা দেয়া হলেও এসব ব্যক্তি পৌরসভায় কাজ করেন না। পৌরসভার বাইরে ২৮ জন কাউন্সিলরের আলাদা কোনো অফিস থাকার বিধান না থাকলেও প্রতি বছর কাউন্সিলরদের গুদাম ভাড়ার নামে সাত লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। যার অর্ধেক মেয়র আত্মসাৎ করে দুই বছরে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ, পৌরসভার মোট রাজস্ব আয় ২৫ কোটি টাকা।

রাজস্ব কর্মচারী লেবার, সুইপার ও মাস্টাররোল বেতন ভাতাদি বাবদ ব্যয় হয় বছরে ১০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১৫ কোটি টাকা বিভিন্ন ভুয়া টেন্ডার, ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে পৌর তহবিল থেকে আত্মসাৎ করে। এছাড়া মেয়রের নিজস্ব বাহিনী(মাস্তান) দিয়ে বাজার দখল, হাট বাজার, বাস টার্মিনাল, ইজারা থেকে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ, গত ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে টিআর’র প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। তিনি টিআর’র টাকার কোনো কাজ না করে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের নামে ভুয়া প্রকল্প দেখান ও বিল ভাউচার দাখিল করেন।

এদিকে অভিযোগকারী পৌরসভার ঠিকাদার এমএকে আজাদ বলেন, মেয়র আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। দুর্নীতিবাজ মেয়রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ৩ জুলাই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপ-সচিবের ১৭ আগস্ট স্বাক্ষরিত পত্রে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে আমি আশাবাদী।

অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক(ডিডিএলজি) মাসুম আলী বেগ বলেন, বগুড়া পৌরসভার মেয়রের বিরুদ্ধে পৌরসভার তহবিল তছরুপ ও দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত একটি চিঠি হাতে পেয়েছি। অভিযোগের বিষয়গুলো সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।