দীপক সরকার, বগুড়া: বহুল প্রতীক্ষিত বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ অবশেষে শুরু হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া প্রান্তে জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নতুন ডুয়েলগেজ ৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বগুড়া অংশেই ব্যয় হবে ৯০০ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুমোদনের ছয় বছর পর এ অর্থ বরাদ্দ এলো।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শফিউর রহমান স্বাক্ষরিত ১৬ জুনের একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বগুড়া হতে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুযায়ী ‘ভূমি অধিগ্রহণ’ খাতে মূলধন ব্যয় হিসেবে এই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
চলছে রেলপথ নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া। এই ৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ হলে সিরাজগঞ্জ-বগুড়ার মানুষের সহজ যাতায়াত নিশ্চিতসহ ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের জেলার শত কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। একই সঙ্গে অল্প খরচে কৃষিপণ্য দেশে পরিবহন করা যাবে। এতে গতিশীল হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের মধ্যকার দূরত্ব । তবে নতুন রেলপথ চালু হলে এই পথ ৫ ঘণ্টার মধ্যে অতিক্রম করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি এম ইমরুল কায়েস বলেন, বগুড়া অংশে ভূমি অধিগ্রহণে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা চাহিদা ছিল। বরাদ্দ মিলেছে ৯০০ কোটি টাকা।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ভারতের তৃতীয় লাইন অফ ক্রেডিটের (এলওসি) ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন থেকে বগুড়ার রানিরহাট রুটে সরাসরি রেল সংযোগ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বগুড়া স্টেশন থেকে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশনের মধ্যকার রুটের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৭২ কিলোমিটার।
২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় ঋণের অর্থে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ দেবে ভারত। শুরুতে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগ এবং নকশা চূড়ান্ত করা নিয়ে বিলম্বের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে।
প্রকল্পের আওতায় দুটি পৃথক রেলপথ নির্মাণ করা হবে। একটি রেললাইন যাবে বগুড়ার ছোট বেলাইল থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত (৭৩ কিমি) এবং অপরটি কাহালু থেকে রানীরহাট পর্যন্ত (১২ কিমি)। এতে বগুড়া শহরের বাইরে রানীরহাটে একটি নতুন জংশন নির্মাণ করা হবে। আরেকটি জংশন হবে সিরাজগঞ্জে। এ ছাড়া দুটি জেলার মধ্যে শেরপুর, আড়িয়া বাজার, ছোনকা, চান্দাইকোনা, রায়গঞ্জ ও কৃষ্ণদিয়া- এই ছয়টি নতুন স্টেশন স্থাপন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৮৫ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ (ব্রড গেজ ও মিটার গেজ) নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য মোট ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। বগুড়া জেলার সীমানায় অধিগ্রহণ করা হবে ৪৭৯ দশমিক ১৫ একর। বাকি ৪২০ দশমিক ৬৮ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হবে সিরাজগঞ্জে। ভূমি অধিগ্রহণ খাতের ব্যয় হিসেবে প্রকল্পে ১ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি রেলপথ না থাকায় এ অঞ্চলের ট্রেনগুলো বর্তমানে সান্তাহার, নাটোর ও পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে। বাড়তি পথ ঘুরতে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় হচ্ছে, তেমনি বেশি ভাড়াও গুণতে হচ্ছে। বগুড়া থেকে যেখানে সড়কপথে ঢাকা পৌঁছাতে লাগে ৬ ঘণ্টা, সেখানে ট্রেনে যেতে লাগে ১০–১১ ঘণ্টা। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুই জেলার মধ্যে দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। নতুন রেলপথ চালু হলে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে মাত্র ৫ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি(ভারপ্রাপ্ত) সাইরুল ইসলাম বলেন, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি রেলপথ নির্মিত হলে রংপুর অঞ্চলের অন্তত আটটি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। জয়পুরহাট এবং নওগাঁরও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতি হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের চেহারা পাল্টে যাবে।