ঈদকে সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠছে বগুড়ার বেনারসি পল্লী


দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: ঈদ এলেই ‘খটাশ-খটাশ’ শব্দে মুখর হয়ে ওঠে বগুড়া শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনির বেনারসি পল্লী। সেই সঙ্গে ঘূর্ণমান মেশিনে সূতো গোছানোর পাশাপাশি ড্রাম মেশিনের সাহায্যে সুতা প্রসেসিংসহ শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ততা। কারিগরদের হাতের নিপুঁন ছোঁয়ায় নারী ও শিশুদের নিত্য নতুন ডিজাইনের সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পোষাক তৈরী করতে হয়।

তাদের তৈরী বেনারসি শাড়ি রাজধানি ঢাকার পাশাপাশি নিজ জেলা বগুড়াসহ রংপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতো বেনারসি শাড়ি ব্যবসায়ীরা। এক সময় শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও কালের আবর্তনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সামগ্রী মূল্য বৃদ্ধিতে এখন ভালো নেই বেনারসি পল্লী শাড়ি তৈরির কারিগররা।

অধিকাংশই পেশা বদল করে ভ্যান-রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ কেউ বাপ-দাদার পুরানো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে পেশাটাকে ধরে রেখেছেন। বর্তমান সময়ে ভারত থেকে আসা শাড়ি দখল করে নিয়েছে দেশের বেনারসি পল্লীর তাঁতে তৈরি শাড়ির বাজার। যার কারনে ব্যবসায়িকভাবে ভাল নেই বেনারসি তৈরীর কারিগররা।
বগুড়া জেলা থেকে ২৮ কিলোমিটার দুরে শেরপুর উপজেলা সদরের দক্ষিণ-পশ্চিমেশাহ-বন্দেগী ইউনিয়নের ঘোলাগাড়ী কলোনী। এ গ্রামটি বেনারসি পল্লী নামে পরিচিত।

সোমবার (৩ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে দেখা মেলে বেনারসি পল্লীর শাড়ি তৈরিতে কারিগরদের কর্মব্যস্ততা। আলাপ-চারিতায় জানা যায়, ঘোলাগাড়ি কলোনিতে বেনারসি পল্লী গড়ে উঠার পিছনের ও বর্তমান পরিস্থিতির কথা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আব্দুল ওয়াহেদের পরিবারের পূর্বপুরুষরা (বিহারীরা) অনেকের মতো চলে এসে ঘোলাগাড়ি কলোনীতে পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

তবে এ গ্রাম থেকে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যে খচিত বেনারসি শাড়ী তৈরী হওয়ায় দেশের মধ্যে বেনারসি পল্লী নামে বেশী পরিচিত হয়েছে। ঘোলাগাড়ী কলোনি ‘বেনারসি পল্লীতে’ ১৯৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ধীরে ধীরে নারীরাও এ পেশায় নিজেদের যুক্ত করতে থাকেন। সাংসারিক কাজের ফাঁকে-ফাঁকে এ কাজ করেন তারা। বেনারসি পল্লীতে বেনারসি, বুটিক, জামদানি, টাইটাকি, কাতান, কাতান বুটিক, পাটি নামের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি বানানো হয়। এসব বাহারি শাড়িতে ফুটে ওঠে প্রতিটি বাঙালি ললনার প্রকৃত রূপ-মাধুরি। আর সেই শাড়ি যদি মানসম্পন্ন ও পছন্দের হয় তবে তো কথাই নেই। এখানে ৩২ জন সদস্যের ‘১০ নম্বর শাহবন্দেগী প্রাথমিক তাঁতী সমিতি’ রয়েছে।

বেনারসি পল্লী ঘুরে দেখা যায়, পোশাক তৈরিতে মাটি কেটে নির্দিষ্ট স্থানে চার কোণাকৃতির গর্ত তৈরি করা হয় প্রত্যেক কারখানার জন্য। গর্তে আসন গেড়ে বসেই মেশিন চালান কারিগরা। বাহারি ডিজাইনের ক্যাটালগ লাগানো হয় প্রত্যেক তাঁত মেশিনে। সামনে জালের মত বিছানো রঙ বেরঙ-এর সুতা। কারিগরের হাত-পায়ের তালে তালে চলছিল তাঁত। সচল মেশিনে সুতোভর্তি কাঠ নিয়ে একহাত এপাশ-ওপাশে চালনা করছিলো তাঁতী। সমানতালে চালাচ্ছিলেন পা। মেশিন সচল রাখতে গিয়ে হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসে তাদের। কিন্তু যতো ক্লান্তিই হোক মেশিন বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ একদম নেই।

কেউ কেউবা মনের আনন্দে গুন গুন শব্দে গান গাচ্ছে, কেউবা বাজাচ্ছে সাউন্ডবক্সে মোবাইলের মেমোরি ভরা গান। তবে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চালায় শাড়ি বুননের শেষ কাজ। আর এ কাজগুলো শেষ হয় কয়েকটি ধাপে। শেষ পর্যায়ে এসে নারী-পুরুষের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় রং- বেরংয়ের হাজারও সুতোই হয়ে ওঠে একেকটি আকর্ষণীয় শাড়ি। ভারত, পাকিস্থান, তাইওয়ান, চায়না ও দেশীয় সুতার ব্যবহার হয়ে থাকে এ শাড়িগুলোতে।
এই পল্লীতে তৈরী হচ্ছে বেনারসি বুটিক, টাইটাকি পার আঁচল, জামদানি, ব্রকেট, কাতান, কাতান বুটিক, পাটি নামের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি।

আর এসব পাইকারি দর হিসেবে প্রতিটি রেশমি সুতোয় তৈরি শাড়ির দাম পড়ে ৯ থেকে ১০, বেনারসি বুটিক ২ থেকে আড়াই, জামদানি ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার , ব্রকেট সাড়ে ৩ থেকে ৪, কাতান ৪ থেকে সাড়ে ৪, কাতান বুটিক সাড়ে ৩ থেকে ৪, পাটি ৫ থেকে সাড়ে ৫, টাইটানিক ১ থেকে আড়াই, পারআঁচল দেড় থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বর্তমান বাজারে বেনারসি পাইকারি বাজারে ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা, জামদানি ৪ হাজার ৫শ’ থেকে ৮ হাজার পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে এসব শাড়ি ক্রয়ে প্রধান ক্রেতারা হলো রাজধানী ঢাকার মিরপুরে ব্যবসায়ীরা। আর এ এসব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায় এলাকার বেনারসি শাড়িগুলো। তাছাড়া প্রযুক্তিগত সাপোর্ট না থাকায় বেনারসি পল্লীতে কারিগরদের একটি বড় সমস্যা। তাই ঢাকার মিরপুর বেনারসি পল্লীতে গিয়ে ফিনিশিংয়ের কাজ করতে হয় বলে কারিগররা জানান।

মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বেনারসি পল্লীতে এতোসব আয়োজন। দরজায় কড়া নাড়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে ঘনিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেনারসি তৈরিতে দিনরাত অতিবাহিত করছেন কারিগররা।

আলাপচালিতায় কারখানার মালিক ও কারিগর আব্দুল কাদির, আজাদ মঞ্জু জানান, ছোট থেকেই তারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। প্রথমদিকে একটি শাড়ি তৈরিতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে যেতো। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। গ্রামীণ অবকাঠামো ভালো ছিল না। এখন কলোনিতে বিদ্যুৎ রয়েছে। রাস্তা-ঘাটও আগের তুলনায় বেশ ভালো। বর্তমানে দুই-তিন দিনেই তৈরি করা যাচ্ছে উন্নতমানের একেকটি বেনারসি শাড়ি।

আজিম উদ্দিন, রশিদ মিয়া জানান, তাদের তৈরি শাড়িগুলো বিক্রি করেন ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ীদের। মিরপুর-১০, ১১, ১২ এর ব্যবসায়ীরা ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তৈরি করা বেনারসি শাড়ির প্রধান ক্রেতা। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় এসব শাড়ি বিক্রি করা হয়ে থাকে। তবে তা সংখ্যায় অনেক কম। সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ব্যবসায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারছেন না। অন্যদিকে এসব শাড়ি তৈরীর জন্য তিন ধাপে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা গড়ে তুলতে সে সময় তার প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয় বলেও মন্তব্য করেন তারা।

একই সঙ্গে কথা হয় নারী কারিগরদের সাথে। এ সময় সালমা আক্তার, রুমি খাতুন, জাহানারা বেগম, ডালিয়া খাতুন সহ কয়েকজন জানান, অভাবের সংসারে সকলে মিলে পরিশ্রম করলে আয় বাড়ে। এতে অভাব অনেকটা কেটে যায়। তাই স্বামীর সঙ্গে তারা নিজেরাও সুতা, জড়ি, কেলা, তানি, রং এর কাজ করতে এ পেশায় নিয়োজিত করেছেন।

কারখানা মালিক ও শ্রমিক সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে মো. ওয়াহেদ রানা জানান, ১৯৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তারাসহ হাতে গোনা কয়েকজন প্রথম শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। তিনি একজন কারখানা মালিক ও কারিগর। বেনারসি পল্লী খ্যাত এ এলাকায় শাড়ি তৈরির কাজ আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। এক যুগ আগেও এ উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনি, বড়পুকুর ও পাঁচআনা এলাকায় এক সময় ব্যাপক পরিসরে বেনারসি শাড়ি তৈরি করতো কারিগররা। শুধুমাত্র ঘোলাগাড়ী কলোনি এলাকায় ৫০টির মতো তাঁত মেশিন স্থাপন হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১৫টিতে। কাঁচামাল সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে বর্তমানে বেনারসি শাড়ি তৈরি করে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে তেমন লাভের মুখ দেখতে পান না কারখানা মালিকরা। তাই এ পেশা বদল করছে অনেকেই।

তাছাড়া আগে সরকার কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে তাঁতিদের বা কারখানা মালিকদের মেশিন প্রতি ১৮ হাজার টাকা করে ঋণ দিতেন। বর্তমানে তা বাড়িয়ে প্রায় লাখ টাকা করেছেন। কিন্তু ঢাকার ব্যবসায়ীরা সঠিক সময় তাদের পণ্যের মূল্য পরিশোধ না করায় ঋণের টাকা পরিশোধে হিমসিম খেতে হয় তাদের। কেননা অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের তৈরি পোশাকের সিংহভাগ বিক্রি করতে হয় ঢাকায়।

তাই এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে মালিক ও কারিগররা সরকারের সু-দৃষ্টি প্রয়োজন। সম্পূর্ণ মেশিনে তৈরি ভারতীয় শাড়ী আমদানির জন্য ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে তাদের। তবে হাতে তৈরি এসব পোশাকের কদর অন্যরকম। সরকারি অনুদান পেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশাবাদি এমনটাই জানিয়েছেন কারিগর ও সংশিষ্টরা ।