এশিয়া মহাদেশের মধ্যে উচ্চতম ও দ্বীতল রেল স্টেশনটি সমস্যায় জর্জারিত


আল-আমিন হোসেন, আলমডাঙ্গা থেকে : আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন যা আজ শুধু স্টেশন বলে পরিচিত তা মূলত নীলকর ইংরেজদের একটি কুঠি। এখান থেকে তারা এ অঞ্চলের নীলচাষের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করত।
ভবনের ওপর থাকত ইংরেজ সাহেব। নিচতলার কামরাগুলো ছিল তাদের গুপ্তঘর বা জেলখানা। এই কামরাগুলো এমনভাবে নির্মিত যে, তার ভেতর আলো, বাতাস এমনকি বাইরের শব্দ পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারত না।

যারা নীল চাষ করতে অস্বীকার করত তাদেরকে ধরে এনে কুঠির নিচতলায় আটকিয়ে রাখা হত এবং  তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হত। আজকে সে যাইগায় আলমডাঙ্গা রেলস্টেশন। সেদিনের এই নীলকুঠিতে জানা-অজানা অনেক কলঙ্কময় ঘটনা ঘটেছে।

আলমডাঙ্গার জনপদকে স্মরণ করিয়ে দেয় আলমডাঙ্গার বেদনাময় অতীতকে।

এই স্টেশনটি বাংলাদেশের একমাত্র দ্বিতল  রেলস্টেশন । ভারতবর্ষে প্রথম রেল চালুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এ রেলস্টেশন ভবনের গোড়াপত্তন বলে ধারা হয়। তৎকালে বিলের মধ্যদিয়ে এ রেললাইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে রেললাইন অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। মোঘল আর ইংরেজ আমলের বিশেষ স্থাপত্য শৈলীর এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এ দ্বিতল স্টেশনটি। এখানে শুধু দোতলা স্টেশন ভবনই নির্মাণ করা হয়নি, এ দোতলা রেলস্টেশনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ইউরোপ থেকে সৌন্দর্যবর্ধক বহু বিরল প্রজাতির গাছ নিয়ে এসে লাগান হয়েছিলো।

বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালে। সে সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার লাইন স্থাপিত হয়। নীলকরদের বিরুদ্ধে এতদাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের কারণে বিতাড়িত কিছু নীলকর জগতিতে আখ মাড়াইয়ের কল উৎপাদন শুরু করেছিলো। ভারী ভারী আখমাড়াইয়ের কল বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের নিকট পৌঁছানো সহজ হবে বলেই রেলপথের যাত্রা শুরু হয়।

উপমহাদেশে রেলের ইতিহাসে আভিজাত্যপূর্ণ ঐতিহ্যের স্মারক আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনটি এখন নানা সমস্যার জর্জারিত। দৃষ্টিনন্দন ও আভিজাত্যপূর্ণ নির্মাণশৈলীর এ দ্বিতল স্টেশন ভবনটির আদি স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণ্ণ রেখে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। বেশ কয়েক বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই রেলস্টেশন ভবনটির কোন সংস্কার করা হয়নি। দীর্ঘদিনের অবহেলায়  জন্মেছে জঙ্গল। সামনের দেয়ালের ইট সুড়কির ফাঁকে  বসবাস বট-পাকড়ের বনসাইয়ের। এমনকি জন্মেছে ধনচে জাতীয়  আগাছা। দেখে মনে হয় এ ঐতিহ্যের স্মারক দেখভালের কেউ নেই।

এদিকে গত তিন বছর আগে আম্পান ঝড়ে ১নং প্ল্যাটফর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আজও সংস্কার হয়নি। আসলে কি কারনে অবহেলিত এই স্টেশনটি তা আলমডাঙ্গাবাসীর জানার জন্য কৌতুহল সৃষ্টি হয়ে আছে অনেক দিন ধরে । অন্যদিকে স্টেশনের সংস্কার, ঢাকাগামী ট্রেনের বরাদ্দকৃত সিট সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন ট্রেনের দাবিতে সম্প্রতি বেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসীর উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র দ্বিতল রেলওয়ে স্টেশন ভবনের আদি নির্মাণশৈলী অক্ষুন্ন রেখে আধুনিকায়ন, আপ ও ডাউন প্লাটফর্ম বর্ধিতকরণ, এক্সপ্রেস রোড, ফুটওভার ব্রিজ স্থাপন, যাত্রী ছাউনি বর্ধিতকরণ ও চিত্রা-সুন্দরবন এক্সপ্রেসের বরাদ্দকৃত আসনসংখ্যা  বৃদ্ধি। এ ছাড়াও আলমডাঙ্গা অঞ্চলে রেললাইনে ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।

গত ৩০ শে জানুয়ারী ২০২১ বুধবার রেলস্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ করতে সরকারিভাবে স্টেশন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি এসে পৌঁছায়। এরপর থেকে টিকেট কাউন্টার ছাড়া বন্ধ হয়ে যায় সকল কার্যক্রম। তারপর জনগন এবং স্টেশন রক্ষা কমিটি বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে স্টেশনের পূর্বের ধারা ফিরে পায়। কিন্তু আন্দোলনের মুখে সেটি ফিরে পেলেও ফিরে পাইনি আলমডাঙ্গা বাসির চাওয়া পাওয়া। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা একটি বৃহত্তম উপজেলা। বিশেষ করে এই  উপজেলাতে বিভিন্ন ছাত্র -ছাত্রী এবং চিকিৎসা নিতে যাওয়ার রোগীরা  ঢাকা এবং রাজশাহীর সাথে ট্রেনে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হওয়ায় নিরাপদ জার্নি হিসেবে ট্রেনকেই বেঁচে নেই।

কিন্তু সেই টিকিট সাধারণ মানুষের  ধরাছোঁয়ার বাইরে। আলমডাঙ্গা ট্রেনের টিকেট সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হলো চাহিদার  তুলনায় টিকিটের পরিমাণ খুবই নগণ্য। কর্তৃপক্ষের কাছে আলমডাঙ্গাবাসীর চাওয়া  সকল ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো দ্রুত  সংস্কার করে দৃষ্টিনন্দন এ দ্বিতল স্টেশন ভবনটির আদি স্থাপত্যশৈলী ইতিহাস হিসাবে যুগের পর যুগ মাথা উঁচু করে জানান দিবে নিলাকরদের অত্যাচারের ইতিহাস।