কালো সোনায় কৃষকেরা স্বপ্ন বুনছে


স্টাফ রিপোর্টার: দেখতে কদম ফুলের মতো হলেও এটি কোন সাধারণ ফুল নয়। এটি পেঁয়াজের বীজের সাদা অংশ যা স্থানীয়দের কাছে থোকা বা পেঁয়াজের বীজ নামে পরিচিত। সাদা কদমের মত ফুলে ভরে গেছে বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মাঠ গুলো। বাতাসে মাঠজুড়ে দোলা খাচ্ছে পেঁয়াজের ফুল গুলো। সাথে সাথে সাদা কদম ফুলে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। সে ফুলে গুন গুন শব্দ করে বসছে মৌমাছি। সাদা কদমের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কালো সোনা। এ কালো সোনায় কৃষকেরা স্বপ্ন বুনছে।

বলছে, এ অঞ্চলে পেঁয়াজ বীজের চেয়ে লাভজনক ফসলের চাষ আর নেই। তাই এর ব্যাপক সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ বীজ চাষে এখনো কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেনি। আবহাওয়া পেঁয়াজ বীজ চাষের অনুকুলে রয়েছে বলে এ উপজেলার পেঁয়াজ বীজ চাষিরা ভালো ফলনের আশা করছে।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মওসুমে বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত শুধু রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলাতেই ৮৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ হয়েছে। গত মওসুমে গোদাগাড়ীতে পেঁয়াজ বীজ চাষ হয়েছিলো ৯৫ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে একটু কম চাষ হয়েছে। কারন হিসাবে জানায়, গত বছর ১ম দিকে পেঁয়াজ বীজের দাম কৃষকরা ভাল দাম পেলেও শেষ সময় দাম কম পেয়েছে। তাই এ বছর একটু চাষ কম হয়েছে।

কৃষি বিভাগ বলছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি পেঁয়াজ বীজ চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এছাড়া পেঁয়াজ বীজ চাষ অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের চাষিরা পেঁয়াজ বীজ চাষে করে লাভবান হচ্ছে। চলতি বছর উপজেলার মাটিকাটা, গোগ্রাম, দেওপাড়া, রিশিকুল, গোদাগাড়ী ইউনিয়নসহ কাকনহাট পৌরসভায় বেশী পেঁয়াজ বীজ চাষ হয়েছে। তবে মাটিকাটা ইউনিয়নে সবচাইতে বেশী চাষ হয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবিঘা জমিতে পেঁয়াজবীজ চাষে খরচ হয়ে থাকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। আর উৎপাদন বিঘা প্রতি দই থেকে চার মণ। গত মওসুমে ১ম দিকে গোদাগাড়ীতে এই বীজ বিক্রি হয়েছে মণ প্রতি ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে শেষ সময় বিক্রি হয়েছে মণ প্রতি ৬০ হাজার টাকায়।

কথা হয় গোদাগাড়ী উপজেলার মেসার্স বন্ধু বীজ ভান্ডারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো:আব্দুল খালেকের সাথে। সে জানায়, উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের দমদমা, আগলপুর, বড়সিপাড়া, মধুমাট এলাকায় প্রায় ১০ একর জমিতে পিয়াজ বীজ চাষ করছে। প্রতি বিঘায় খরচ আনুমানিক ৫০ হাজার টাকা। ফলন নির্ভর করে সম্পূর্ণ আবহাওয়ার উপর এবং প্রাকৃতিক মৌমাছির উপস্থিতির উপর। বিঘা প্রতি ফলন দুই থেকে চার মন পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে বাজারে বেশি চাহিদা সম্পন্ন জাত তাহেরপুরি,কিং, হাইব্রিড এগুলোই চাষ করেছে সে।

সে আরো জানায়, পিঁয়াজ বীজ চাষের জন্য প্রথমে পিয়াজ সংগ্রহ করতে হয় এবং জাত সম্বন্ধে ধারণা থাকতে হয়, কোন জাতের বীজ চাষ করবে সে জাতের পিয়াজ সংগ্রহ করতে হয়।

পিয়াজ বীজ চাষের জন্য নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পিয়াজ লাগানো হয় এবং মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের মধ্যে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। এখানকার উৎপাদিত বীজগুলো বেশির ভাগেই দেশের পাবনা ফরিদপুরে বিক্রি হয়ে থাকে। এই মৌসুমে ভালো ফলন এবং লাভের আশা করছে সে।

হরিশংকর পুর গ্রামের কৃষক মঈন বলে, চলতি মৌসুমে সাড়ে ১০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ করেছে। বিঘা প্রতি পেয়াজ লেগেছে ৮ থেকে ১০ মণ করে। তার জমিতে পেঁয়াজের ফুল ভালো হয়েছে। কোন দুর্যোগ না হলে ভাল ফলনের আশা করছে সে।

উপজেলার প্রান্তিক চাষিরা জানাই, পেঁয়াজের ফুল এক মাস ধরে ফোটে। এক সঙ্গে এত মৌমাছিও পাওয়া যায় না। পরাগায়নের জন্য মৌমাছিসহ মৌবাক্স ভাড়া করে নিয়ে এসে পেঁয়াজ বীজের জমিতে রাখতে হয়। এছাড়াও শ্রমিক দিয়ে হস্ত পরাগায়ন করতে হয়। প্রান্তিক চাষিরা আরো জানাই, পেঁয়াজবীজ চাষে কোন লোকসান নেই-একথা সত্য। তবে অনেক সময় ভারত থেকে পেঁয়াজবীজ আমদানির জন্য গোদাগাড়ীর পেঁয়াজবীজের দাম কমে যায়। এতে চাষিরা ভালো দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদ বলেন, ‘প্রতি বছর পেঁয়াজের মওসুম শুরুর আগেই কৃষকদের নিয়ে মাঠ কর্মশালার আয়োজন করে কৃষি বিভাগ। সেখানে তাঁদের ভালো বীজ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। পেঁয়াজের বীজ চাষে মৌমাছি নিয়ে সমস্যা হয়। বীজের পরাগায়নে সমস্যা হয়। তবে আমরা কৃষকদের হস্ত পরাগায়নের পরামর্শ দিয়েছি। এছাড়াও সাদা কাপড়ের মাধ্যমে পরাগান ঘটানোর কথা বলেছি। এতে বীজ ভালো মানের ও বেশি ফসল উৎপাদন হবে।’