কে.বি.এম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ “মাহমুদ মোকাররম হোসেনের” ২১ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ


মোঃ মঈন উদ্দীন চিশতী, দিনাজপুর: আজ (৪ জুলাই) কে.বি.এম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ “মাহমুদ মোকাররম হোসেনের” ২১ তম মৃত্যুবার্ষিকী। অধ্যক্ষ “মাহমুদ মোকাররম হোসেনের ২১ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কে.বি.এম কলেজের সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়।

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন ১৯২৬ সালে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার যোগীবাড়ী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেণ।৷ তার পিতামহ হাজী মোহাম্মদ হেদায়েতুল্লাহ পুঁথি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।

তিনি ১৮৭০ সালে ” মফিদুল হোজ্জাজ” নামে তিনি একটি পুঁথি রচনা করেন । পরবতী’তে অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেনের পিতা হাজি মোহাম্মদ দানেশ বধি’ত আকারে ” মফিদুল হোজ্জাজ” (হাজিদের বন্ধু) প্রকাশ করেন। এই পুঁথি বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ।

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন ১৯৫১ ইং সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম,এ পাশ করে দিনাজপুর এস.এন কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ সরকারি কলেজে পরিনত হলে তিনি চেরাডাঙ্গী কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন।

কে,বি,এম কলেজ স্থাপনের রূপকার তৎকালীন চেরাডাঙ্গী কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলার বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ জনাব মাহমুদ মোকাররম হোসেন চেরাডাঙ্গী কলেজটি শহরের দিকে স্থানান্তরিত করে বর্তমান স্থানে প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাঁকে বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আ কা ম যাকারিয়া যিনি কলেজের জন্য ১৫ একর জমি অধীগ্রহণ করে দেন এবং সহযোগিতা দিয়েছিলেন তৎকালীন চেরাডাঙ্গী কলেজের পরিচালনা পষ’দের সদস্য বৃন্দ।

চেরাডাঙ্গীতে একটি কলেজ স্থাপনের জন্য সেইদিন ঐ এলাকার সামাজিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেনের আহবানে সাড়া দিয়ে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, বলিষ্ট ভুমিকা রেখেছেন জেলার তথা দেশের উত্তরাঞ্চলের শিক্ষা সম্প্রসারণের ইতিহাসে তা এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে। চেরাডাঙ্গী হাই স্কুলের সেক্রেটারী এবং চেরাডাঙ্গী মেলা কমিটির সেক্রেটারী এবং তখন চেরাডাঙ্গী কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলার অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন জনাব মোকাররম হোসেন

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হসেনের যোগ্য নেতৃত্ব এবং শিক্ষক বৃন্দের অবিরাম প্রচেষ্টা, স্থানীয় এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের সুকামনা এবং প্রবাহমান ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগীতায় কেবিএম কলেজ আজ দেশের একটি সুপরিচিত বৃহৎ বেসরকারী ডিগ্রী কলেজ। এই কলেজের প্রতিষ্ঠিত অধ্যক্ষ হিসেবে প্রায় ৩৪ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন পন্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ছোট গল্প লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত লাভ করেন। তার রচিত বেশ কিছু লেখা সেসময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি বেশ কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা।

তিনি আধুনালুপ্ত “সাপ্তাহিক কাঞ্চন”এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত “নওরোজের” সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন।

তিনি ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য সংগঠন “নওরোজ সাহিত্য মজলিসের” সভাপতি হিসেবে ২০ বছর কাজ করেছেন।

দিনাজপুরে নওরোজের সাহিত্য সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে দিনাজপুরে আগত ড. মোহম্মদ শহীদুল্লাহ যে কয়দিন দিনাজপুরে ছিলেন সেই কয়দিন তিনি তার স্নেহধন্য ছাত্র মাহমুদ মোকাররম হোসেনের বাসায় অবস্থান করেছিলেন।

তিনি তৎকালিন বাংলাদেশ বেসরকারী কলেজ অধ্যক্ষ পরিষদ এর সভাপতি ছিলেন।

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন দিনাজপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। দিনাজপুরের বৃহত্তর ও সুপ্রাচিন গ্রন্থাগার খাজা নাজিমুদ্দিন হল ও লাইব্রেরির নিবা’চিত সম্পাদক হিসাবে প্রায় ২১ বৎসর যাবত দক্ষতার সাথে লাইব্রেরির উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি দিনাজপুর মিউজিয়ামের সাধারণ সম্পাদক ও কিউরেটর ছিলেন।

স্বাধীন ও সবভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু সরকার বিজাতীয় ব্রিটিশ ও উপনিবেশিক শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন করে বাংলাদেশের উপযোগী এক শিক্ষানীতি প্রবত’নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেণ। অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন এই কমিশনের পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম পূণ’কালিন সদস্য নিবা’চিত হন।

দেশ বরেন্য বিজ্ঞানী ড. কুদরত এ খুদা এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন।
অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন এই কমিশনের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন দেশ সফর করেন।

তিনি সরকার কতৃক এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠন কতৃক শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নিবা’চিত হন এবং স্বণ’ পদক লাভ করেন। ২০০০ সালে ততকালীন সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়া তাকে মরনোত্তর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মযা’দা দিয়ে স্বণ’ পদক প্রদান করেন।

১৯৯৫ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাক’ শিক্ষা সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষাবিদ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার ওয়াসিংটন ডি.সি তে “বিশ্ব শিক্ষক” সম্মেলনে অন্যতম শিক্ষক নেতা হিসেবে আমন্ত্রিত হন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেটের তিনি একজন সভ্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের একজন সদস্য ছিলেন।

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি ‘বাকশিস’-এর সভাপতি ছিলেন । স্বাধীন দেশের প্রথম বিপর্যয় দেখা দেয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে। অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন ও অধ্যাপক এম শরীফুল ইসলামের শিক্ষা ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার মধ্যে অন্যতম ১৯৮০ সালে ১ জানুয়ারি থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রথম বারের মতো জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করন।

১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি হলে অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেন, অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুল হাই, অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ নেতাকে গ্রেফতার করে সামরিক জান্তা। ইলেকট্রিক শকসহ নানা নির্যাতনের পর তারা কারাগার থেকে বের হয়ে সব নেতাকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বৈরাচারবিরোধী আপসহীন আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরে বেগম জিয়া সরকার ৯৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক দের অবসর ভাতার সুযোগ প্রদান করেন।

অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেনের শিক্ষা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এর অবদান দেশ ও দিনাজপুর বাসী আজীবন মনে রাখবে।

৪ঠা জুলাই ২০০০ সালে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে এই মহান ব্যক্তিত্ব, দেশ বরেন্য ব্যক্তি, বিনয়ী, মিষ্টভাষী, গুণী শিক্ষাবিদ চির বিদায় নেন।

সূত্রঃ বর্তমান অধ্যক্ষ জনাব জিয়াউল হুদার ও শামিমা ইয়াসমিন বর্ণা( স্যারের মেয়ে), অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।