নাটোরে সাত উপজেলায় আলো ছড়াচ্ছেন নারী ইউএনওরা


নাটোর প্রতিনিধি : নাটোরে সাত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কাজ করছেন নারীরা। উপজেলা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় এই পদে নিয়োগ পেয়ে আলো ছড়াচ্ছেন এসব নারীরা। জাগরণের পতাকা হাতে উন্নয়ন আর অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন নিজের এলাকাকে। নারীর মমতায় গড়ে তুলেছেন জনবান্ধব প্রশাসন।
উপজেলায় যে নারী ইউএনওরা কর্মরত রয়েছেন তারা সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলছেন। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি সব মহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
এ পর্যন্ত কোনও ইউএনওর বিরুদ্ধে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে এই নারী কর্মকর্তারা সময়ের সঙ্গে আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছেন।
দেশের শাসনব্যবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এই ক্যাডারে নারীদের সুযোগ ছিল না। সুযোগ পেয়ে মেধাসহ সার্বিক যোগ্যতা দিয়ে সেই চিত্র আমূল বদলে দিয়েছেন নারী কর্মকর্তারা। শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন।তাঁরই উদাহরণ যেন নাটোর জেলার সবগুলো উপজেলাতেই নারী ইউএনওরা।
 ইনোভেশন আইডিয়ার বাস্তবায়ন, জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগোযোগ রক্ষা ও সেবাদানের কারণে নারী নামের মুগ্ধতা ছড়াচ্ছের তারা।  মেধা, দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জ গ্রহনের একাগ্রতা নিয়ে নাটোরের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিত্বে পুরুষদের সমানতালে এখন নারীদের পদচারনণা। শৃঙ্খলা ও সততার চর্চায় রীতিমতো পুরুষদের পেছনে ফেলেই নারীদের এই এগিয়ে চলা।
নানামুখী চাপ মোকাবিলা করে প্রতিনিয়তই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রের নেতৃত্বস্থানীয় জেলার নারীরা। নাটোর জেলায় সিভিল সার্জন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, নিম্ন আদালতের বিচারক এমনকি পৌরসভার মেয়র হিসেবেও দায়িত্বও পালন করছেন নারীরা।
জেলার সাত উপজেলার সাত নির্বাহী কর্মকর্তাই নারী৷ নাটোর সদর উপজেলায় সারমিনা সাত্তার, নলডাঙ্গায় রোজিনা আক্তার, বাগাতিপাড়ায় নীলুফা সরকার, লালপুরে শামীমা সুলতানা, বড়াইগ্রামে মারিয়াম খাতুন, গুরুদাসপুরে শ্রাবণী রায় ও সিংড়ায় মাহমুদা খাতুন। গত কয়েকবছর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে নারীদের পদয়ান বেশি থাকলেও গত ২২শে ফেব্রুয়ারিতে সিংড়া উপজেলায় মাহমুদা খাতুনের পদায়নের মাধ্যমে নারী নির্বাহী কর্মকর্তাদের শতভাগ পদায়ন নিশ্চিত হন।
গত ডিসেম্বরে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন মাহমুদা শারমিন নেলী। তিনি জেলার প্রথম নারী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তিনি বর্তমানে সদর সার্কেলের দায়িত্বে রয়েছেন।
জেলার সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রোজি আরা বেগম। আর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করছেন বিসিএস ৩১ ব্যাচের রওনক জাহান।
জেলার নিম্ন আদালতের বিচারকার্যেও সরব ভূমিকা নারীদের। আদালতের ১৭ জন বিচারকের মধ্যে ৭ জন নারী বিচারক। এদের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার বিচারক, লিগ্যাল এইড অফিসার, সহকারি জজ, সিনিয়র সহকারি জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা।
প্রশাসন, বিচারকার্য বা আইনশৃঙ্খলা কার্যেই নয়, স্থানীয় সরকারের মতো প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। বর্তমানে দেশের ছয়টি পৌরসভার মেয়র পদে রয়েছেন নারীরা। এদের মধ্যে নাটোরের দুই পৌরসভার মেয়র নারী।
তারা হলেন নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরি জলি ও লালপুরের গোপালপুর পৌরসভার মেয়র রোখসানা মোর্ত্তোজা লিলি৷ অনান্য ক্ষেত্রগুলোতে চাপ সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও জনসেবার সাথে নিকট সম্পৃক্ত এই পদ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের বলে মনে করেন এই দুই মেয়র।
বিসিএস ৩৪ ব্যাচের ক্যাডার ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সারমিনা সাত্তার বলেন, ‘ইউএনও হিসেবে কাজটা সবার আগে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব। এটা আমাকে পালন করতেই হবে।
জনসেবার জন্যই যে জনপ্রশাসন, এই সত্যটিকেই প্রতিষ্ঠিত কারতে চাই। আমি নারী বা পুরুষ, এটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাজ আমাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। পুরুষরাই চ্যালেঞ্জ নিতে পারে শুধু, নারীরা পারে না-এমন প্রথা ভাঙ্গার সময় এখন।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদা শারমিন নেলী বলেন, ‘যে কোন চাকুরীর চেয়ে পুলিশে চাকুরি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। আর তা যদি নারীর ক্ষেত্রে হয় তবে মাত্রাটা আরো বেশি হয়।
তবে এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন সেটা মুখ্য বিষয়। এখানে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। নারীরা যদি নিজেকে প্রথাগত চিন্তা-মননের জায়গা থেকে বের না করে তবে উত্তরণটা কঠিন।
জেলা সিভিল সার্জন রোজি আরা বেগম বলেন, কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনো তুলনামূলক কম। তবে নেতৃত্বগুণ থাকলে একজন নারীই তার সকল সহকর্মীদের সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাহস ও সদিচ্ছা দরকার।
সেই সাথে একজন নারীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদার, সহানুভূতিশীল ও সহযোগি দৃষ্টিভঙ্গি। অনুকূল কর্মপরিবেশ পেলে নারীর অগ্রযাত্রা আরো অপ্রতিরোধ্য হবে।
নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরি জলি বলেন, জনপ্রতিনিধিত্বে একজন নারী তখনই সফল হবেন যখন জনগন তাঁর পাশে থাকে। অবশ্যই রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করতে হয়।
কিন্ত নাগরিকদের সহযোগিতা পেলে কাজ করা সহজ হয়। আমি বরাবরই পৌরসভা পরিচালনায় নাগরিকদের অব্যাহত সহযোগিতা পেয়েছি। সাহস নিয়ে এগিয়ে এলে নারীদের পক্ষে সব ক্ষেত্রেই দারুন ভূমিকা রাখা সম্ভব।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রশাসনে পুরুষদের চেয়ে নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কম। নারীরা কর্মস্থলে পুরুষের চেয়ে বেশি নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন যা ইতিবাচক। তাদের অংশগ্রহন বাড়ালে জাতি উপকৃত হবে।
জেলা প্রশাসক(ডিসি) শামীম আহমেদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহন বাড়ছে।
একজন নারী কর্মকর্তা একজন পুরুষ কর্মকর্তার সাথে সমানতালে বা কখনো আরো বেশি দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। নাটোরের প্রশাসনে থাকা নারী কর্মকর্তাগন তাঁদের কাজে সর্বোচ্চ মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন৷ আমরা এই চর্চাকে উৎসাহিত করছি৷