রায়হান আলম, নওগাঁ : দিন, সপ্তাহ, মাস এরপর বছরের পর বছর পার, এখন দেড় যুগ। আজ ১৮ আগষ্ট বহুল আলোচিত নওগাঁর আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন এর ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০ বছর আগে সরেন ভ’মি দস্যুদের হাতে নিহত হলেও এখনো ওই মামলার কোন সুরাহা হয়নি। ওই মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আদিবাসীদের রয়েছে সংশয়। তাদের অভিযোগ জামিনে থাকা আসামীরা তাদের অব্যাহত ভাবে হুমকী-ধমকী দেয়ায় ইতোমধ্যে অনেক আদিবাসী পরিবার ভীমপুর আদিবাসী পল্লী ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে।
অভিযোগ আছে বর্তমানে যে ক’টি পরিবার এখনো বসবাস করছে তারা ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতেও পারছেনা। ফলে পরিবারগুলো চরম অভাব অনটন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। পল্লীর ছেড়ে মামলার সাক্ষীরা চলে যওয়ায় মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী আলফ্রেডের প্রবাসী ছোট বোন রেবেকা সরেন।
সরজমিন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, আলফ্রেড হত্যা মামলার জামিনে থাকা আসামীদের অব্যাহত হুমকী ধমকীতে ২৪টি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলে সেখানে বসবাস করছে মাত্র ৮/৯টি পরিবার। বাঁকীরা প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র চলে গেছে। নিহত আলফ্রেড সরেনের বৃদ্ধ বাবা গায়না সরেনও মারা গেছেন। আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী জোছনা সরেন এই পল্লীতে থাকেন না। আলফ্রেডের রেখে যাওয়া ৪ বছরে মেয়ে ঝর্ণা সরেন বড় হয়েছে। বিয়ে করে থাকছে ঢাকায়। চাকরী করছে গার্মেনটস ফ্যাক্টরীতে। আলফ্রেড সরেন হত্যা কান্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন মৃত্যু বরন করেন।
প্রকাশ আছে ১৮ আগষ্ট ২০০০ সালে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে হাতেম-গদাই গংদের সন্ত্রাসীদের হামলায় আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন নৃসংশভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে আদিবাসী পল্লীর ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাংচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় আদিবাসী মহিলা-শিশুসহ প্রায় ৩০ জন মারাত্মক আহত হয়। ওই সন্ত্রাসী ঘটনার পর নিরপত্তার জন্য সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয় । পরে তা গুটিয়ে নেয়া হয়।
এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাড. মহসীন রেজা জানান, আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার বড় ভাই কমল সরেন ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১জন আসামীর নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েক জন আসামীকে গ্রেফতার করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষী গ্রহন শুরু হয় এবং ৪১জন সাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষী গ্রহন সম্পন্ন হয়েছিল। ৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে।
ওই সময় পলাতক সীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের অধিক আসামী জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে জননিরাপত্তা আইনের সকল রিট হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। এর ফলে আসামীরা জামিনে বেড়িয়ে আসে। এরপর বাদিগন অ্যাপিলেড ডিভিশনে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি অ্যাপিলেড ডিভিশন শুনানী অন্তে পূর্নাঙ্গ শুনানীর জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রেরন করেছে। তিনি রিটগুলো দ্রুত শুনানী করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন মুকুল বলেন, আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনকে হত্যার পর অগ্নিসংযোগ করে, নারী ও শিশুদের উপর নির্যাতন করে। হত্যার পর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় নেতৃবৃন্দ নিয়ে ১৮/২০ হাজার লোকের সমন্বয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে পরবর্তীতে সফল লড়াই করেছিলাম। তিনি আরও বলেন, সারা দেশে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন হচ্ছে। সরকারের নিকট অবিলম্বে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করন ও পৃথক স্বাধীন ভুমি কমিশন গঠনসহ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী জানান।
নিহত আলফ্রেড সরেনের ছোট ভাই মহেশ্বর সরেন বলেন , আসামীরা এখনও আমাকে হত্যার হুমকী দিচ্ছে। ৬৩ বিঘা জমির মধ্যে ৩৩ বিঘা জমি তারা নিয়ে নিয়েছে। বাকী ৩০ বিঘা জমিরও ভ’মি অফিসের যোগ সাজেসে চেক কেটে নিয়েছে। আমার ভাই হত্যার পর আদিবাসীরা অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছে বিচারের দাবীতে। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্ত মূুলক শাস্তির দাবী জানাচ্ছি।
এতসব আশংকার মধ্যেও ১৮ আগষ্ট পালিত হবে নিহত আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নওগাঁ জেলা শাখা সূত্রে জানা গেছে, ১৮ আগষ্ট সকালে ভীমপুরে আলফ্রেড সরেনের সমাধীতে পুস্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা জানানো, ১ মিনিট নিরবতা, সমাধী প্রাঙ্গনে আলোচনা সভা ও আদিবাসী সমাবেশ। এছাড়া জেলা বাসদের উদ্যোগে কদমতলীর মোড় থেকে আলফ্রেড সরেনের সমাধী প্রর্যন্ত পদযাত্রার কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে।