বগুড়ায় পিতৃহারা তিন জমজ ভাইয়ের মেডিকেলে ভর্তি জয়


দীপক কুমার সরকার, বগুড়া: স্কুলশিক্ষক গোলাম মোস্তফা মারা গেছে ২০০৯ সালে। রেখে যায় মাত্র ছয় বছর বয়সী মাফিউল, সাফিউল এবং রাফিউল নামের তিন যমজ সন্তান। অদম্য এ তিন মেধাবী একসঙ্গে জন্ম, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েছেন একই প্রতিষ্ঠানে। সবক্ষেত্রে অদম্য মেধাবী তিনজনের ফলাফলও একই।

যমজ তিন ভাই সুযোগ পেয়েছেন চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নের। তবে আলাদা প্রতিষ্ঠানে। বাবা হারালেও মা আর্জিনা বেগম জমি বিক্রি করে তাদের পড়ালেখা করানোর হাল ধরেন। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে শুরু হয় মায়ের জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কৃষিজমিতে আবাদ করে সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতেও মরিয়া ছিল মা। এমনি এক সাফল্যের অন্যতম সিঁড়িপথ তৈরির গল্প উঠে এসেছে বগুড়ায়।

বগুড়া জেলা সদর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ী ইউনিয়নের বথুয়াবাড়ি এলাকার মেডিকেলে চান্স পাওয়া পিতৃহীন জমজ তিন ভাইয়ের কথা। তিন ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই গত বছর এবং অপর দুই ভাই এ বছরের মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পান।

যমজ এ তিন সহোদর মাফিউল হাসান, সাফিউল হাসান এবং রাফিউল হাসান ২০২০ সালে ধুনট সরকারি নইম উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর বগুড়া সরকারি শাহ সুলতাল কলেজ থেকে ২০২২ সালে জিপি-এ ৫ পেয়ে এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হন। মেডিকেলে চান্স পাওয়া ওই তিন ভাইয়ের মধ্যে মাফিউল গত বছর ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে এবং এ বছর সাফিউল দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ও রাফিউল নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছেন। এদিকে বাবাহারা যমজ তিন সহোদরের অভাবনীয় সাফল্যে শুধু বথুয়াড়ী গ্রাম নয়, গোটা উপজেলায় যেন আনন্দের জোয়ার বইছে।

২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর ধুনটের বথুয়াবাড়ি এলাকায় গোলাম মোস্তফা ও আর্জিনা বেগম দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় তিন জমজ ভাই। তিন ভাইয়ের মধ্যে সাফি বড়, তারপর কয়েক মিনিটের ব্যবধানে জন্ম নেয় মাফি ও রাফি। ২০০৯ সালে তাদের বাবা হৃদরোগে মারা যান। বাবা হারালেও মা আর্জিনা বেগম জমি বিক্রি করে তাদের পড়ালেখা করানোর হাল ধরেন। তিন জমজ ভাই এসএসসি পরীক্ষাতে জিপিএ-৫ পেলেও এইচএসসিতে তিন ভাইয়ের মধ্যে সাফি জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হয়।

পরে তারা গত বছর একসাথে মেডিকেল কলেজে ভর্তি দিলে শুধু মাফিউল ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। তবে অপর দুই ভাই প্রথমবার চান্স না পেলেও পরের বার চান্স নিতে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। সেই ফলশ্রুতিতে এ বছর অপর দুই ভাই মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

জমজ তিন ছেলের সাফল্যে আঁচলে চোখ মুছে মা আর্জিনা বেগম বলেন, ‘২০০৯ সালে ওদের বাবা গোলাম মোস্তফা হৃদরোগের মারা যায়। তখন ওদের বয়স পাঁচ বছর। বাবার স্নেহ-মমতা পায়নি ওরা। বাবা মারা যাওয়ার পর তিন সন্তানকে পড়ালেখা করানো নিয়ে বিপাকে পড়ি। নিজে কষ্ট করে এবং জমি বিক্রি করে ওদের পড়ালেখা করিয়েছি। প্রায় পাঁচ বিঘা জমি ছিল। বাবার বাড়ির জমিও বিক্রি করে ওদের পিছে লাগিয়েছি। বাকি যা আছে তাও প্রয়োজনে বিক্রি করব। তবুও ওদের চিকিৎসক বানাব; যাতে আমাদের মত গরিব মানুষদের সেবা করতে পারে।’

মায়ের অবদানের কথা উল্লেখ করে মাফিউল হাসান বলেন, ‘তিন জমজ ভাই বগুড়ায় মেসে একই সাথে থেকে সরকারী শাহ সুলতান কলেজে পড়েছি। মা, কষ্ট করে এবং জমি বিক্রি করে পড়ালেখা করিয়েছে। কখনোই আমাদের কষ্ট করতে দেয়নি।’
জমজ আরেক ভাই শাফিউল হাসান বলেন, ‘আজ বাবা থাকলে অনেক খুশী হতো। বাবাকে হারিয়েছি শিশু কালে। এখন মা, ই বাবার অভাব পূরণ করছে। মানুষের সেবা করার জন্য চিকিৎসক হতে পারি এই দোয়া চাই সবার কাছে।’

অসুস্থ অবস্থায় বাবা মারা যাওয়ার কথা শুনে ডাক্তার হবার প্রতিজ্ঞা করেন রাফিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অসুস্থ অবস্হায় বাবা মারা যায়। যখন বুঝতে পারলাম বাবার সেই কথা তখন থেকেই তিন ভাই প্রতিজ্ঞা করি ডাক্তারী পড়বো এবং মানবতার তাগিদে গরীব মানুষদের পাশে দাড়িয়ে চিকিৎসা করবো। এই গ্রাম থেকে কেউ আগে মেডিকেল চান্স পায়নি। আমরা এক পরিবার থেকে তিনজন মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। এটা একদম অবিশ্বাস্য।’

একই গ্রামের প্রতিবেশী নায়েব আলী নামের ব্যক্তি বলেন, ‘তিন ভাইয়ের এক সাথে মেডিকেলে চান্স পাওয়া আমাদের গ্রামের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা অনেক খুশী হয়েছি। আমরা চাইবো তারা ডাক্তার হয়ে গরীব দুখীদের পাশে দাঁড়াবে।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে তাদের তিন জমজ ভাইয়ের শিক্ষক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এরা তিন ভাই মেডিকেলে চান্স পেয়েছে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। আমি চাইবো তারা যেন দেশ ও দশের কল্যাণে দাঁড়াতে পারে এই দোয়া করি।