বগুড়া শেরপুরে সুলতান’র সুলতানী দাপট, সিরাজী’র সম্বল দলীয় সুবিধা বঞ্চিতরা!


দীপক কুমার সরকার, বগুড়া: ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ৪র্থ ধাপের নির্ধারিত তারিখ আগামী ৫ জুন। আর এ তারিখেই বগুড়ার তিন উপজেলা শেরপুর, ধুনট ও নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে এই নির্বাচনে বিএনপি বা তাদের সমমনা দল অংশগ্রহণ করেনি।

তাছাড়া কৌশলে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন বা প্রতিক বরাদ্দ দেয়নি। তাইতো জনমতের সমর্থনের ভিত্তিতেই সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের ত্যাগী নেতারা নির্বাচনী যুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ ও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষণা অনুযায়ী স্থানীয় সাংসদ প্রতিদ্বন্দ্বি কোন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে পারবেনা।

এমননি দলীয় প্রভাব বিস্তারে উপজেলা পর্যায়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা প্রভাবশালী নেতারা কোন নির্বাচনী সভা- বৈঠক করে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারবেনা। এমন ঘোষণা থাকলেও বগুড়ার শেরপুর উপজেলার চিত্র ভিন্ন।

এখানে সরকারের দলের দুই প্রার্থীর মধ্যে সুলতাল মাহমুদ ক্ষমতার মদদে দলীয় নেতাদের সুলতানী (তৎকালীন স¤্রাট) দাপট নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করে যাচ্ছে। আরেকজন প্রার্থী শাহ জামাল সিরাজীর পক্ষে শীর্ষ নেতার আশির্বাদবিহীন অবস্থায় সম্বল হয়ে পাশে দাড়িয়েছে সুবিধাবঞ্চিত নেতাকর্মী ও স্থানীয় যুবলীগ।

প্রার্থী শাহ জামাল সিরাজী গত ৩১ মে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী সুলতান মাহমুদের কর্মী বাহিনীর দ্বারা তার নির্বাচনী প্রচারনায় বিঘœ ও প্যানা-পোস্টার ছেঁড়া। এমনকি ‘সাংসদের নাম ভাঙ্গিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহনকারী কর্মীদের নানা হুমকী-ধামকী দিয়ে আসছে’ এমন লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জেলা রিটানির্ং কর্মকর্তার কাছে।

এদিকে বগুড়ায় শেষ ধাপের নির্বাচনে তিন উপজেলাগুলোর মধ্যে শেরপুর ও ধুনটে নির্বাচন হবে শেকড় মজবুত করার নির্বাচন। দু উপজেলার মধ্যে বিশেষ করে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সাংসদের বাড়ী শেরপুর উপজেলায় হওয়ায় এ নির্বাচনকে ঘিরে স্থানীয় রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা ভিন্নতর হবে বলে ধারনা করছেন বিশ্লেষকরা। সবমিলিয়ে উভয় প্রার্থীর অভ্যন্তরীণ স্নায়ু যুদ্ধ এখন অনেকটাই প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহ জামাল সিরাজী(মোটর সাইকেল প্রতিক) ও সুলতান মাহমুদ( আনারস প্রতীক) এর দিকে নজর ততটা বাড়ছে।

তাদের প্রচারণায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির গ্রুপিং সামনে আসতে শুরু করেছে। কে হবে উপজেলা চেয়ারম্যান এমন হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সচেতন ভোটাররা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আসার পর বগুড়ার শেরপুর-ধুনটের রাজনীতিতে সাবেক এমপি হাবিবর রহমান ও বর্তমান এমপি(জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) মজিবর রহমান মজনুর দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল তা সংঘর্ষের রূপ নিয়ে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

তৎকালীন এমপি হাবিবর রহমানের গ্রুপের প্রধান শক্তি ছিলো উপজেলা যুবলীগ ও ত্যাগী কিছু নেতারা, আর মজিবর রহমান মজনুর গ্রুপের উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে মজিবর রহমান মজনু এমপি নির্বাচিত হওয়ায় বাহ্যিকভাবে গ্রুপিংয়ের অবসান হলেও উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আবারও সামনে আসছে।

এবারের উপজেলা নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী সুলতান মাহমুদ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সকলেই তাকে বর্তমান এমপি মজিবর রহমান মজনুর কাছের মানুষ বা আশির্বাদপুষ্ট হিসেবে জানেন। তাইতো দলীয় প্রার্থী না হলেও দলীয় পদের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাড গোলাম ফারুক সহ বিভিন্ন সিনিয়র ও জুনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে নির্বাচনী সভা সমাবেশ দৃশ্যমান।

বিশেষ করে স্থানীয় সাংসদের আশির্বাদপুষ্টকেই সমর্থন দিয়েছে উপজেলা ও পৌর কমিটি এমনটাই নিশ্চিত করেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতাকর্মী। তারা মনে করেন ‘যেহেতু সুলতান মাহমুদ দলের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান এমপির কাছের মানুষ, তার পক্ষে কাজ না করে উপায় নেই।’

অন্যদিকে আরেক প্রার্থী শাহ জামাল সিরাজী বর্তমান উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থেকেও কোনঠাসা। তিনি দলের সুবিধা বঞ্চিত নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচনী প্রচার। গত কয়েক দিন উপজেলা যুবলীগ ও কতিপয় সুবিধা বঞ্চিত(ত্যাগী) নেতারাই তার এখন শেষ সম্বল।

অন্যদিকে শাহ জামাল সিরাজীকে ফেলে দিয়ে বর্তমান এমপির গ্রুপ নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে দলের সুবিধাভোগী নেতারা এমনটাই অভিমত জনসাধারণের।

গত ৩১ মে শুক্রবার জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিলের সত্যতা স্বীকার করে চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহ জামাল সিরাজী বলেন, আমি দলের সিদ্ধান্ত মেনে এককভাবে প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু সুলতান মাহমুদ এখনো বিভিন্ন স্থানে দলের বর্ধিত সভার নামে আমার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। তিনি এমন প্রচার করছেন যেন তিনি আওয়ামী লীগ, আর আমি আওয়ামী বিরোধী।

অথচ প্রভাব খাঁটিয়ে আমার পোস্টার ব্যানার খুলে ফেলা হচ্ছে, সমর্থিত ভোটার ও কর্মীদের হুমকী-ধামকি দিচ্ছে। তাদের আচরণে ভোটাররা আতংকিত ও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। প্রতিকার হিসেবে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা এবং কর্মীদের নিরাপত্তার দাবী করেন তিনি।

তবে নির্বাচনী প্রচারণায় দলীয় প্রভাবের কথা অস্বীকার করে চেয়ারম্যান প্রার্থী সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন,”আমি প্রার্থী হওয়ার আগে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীর মতামত নিয়েছি। তারা আমার পক্ষে কাজ করছেন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে প্রতিপক্ষ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য জনগণের মাঝে গুজব ছড়াচ্ছেন।

এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা সুমন জিহাদী বলেন, ‘‘নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হবে।” তবে নির্বাচনী আচরণ বিধি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয়ে কোন অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাচন অফিস সুত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৯জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মাহিলা ভোটার ১ লাখ ৪৯হাজার ১১৫জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৭ ও ভোট কক্ষের সংখ্যা ৮০০। এর মধ্যে স্থায়ী ৬৭৭ ও অস্থায়ী ভোট কক্ষ ১২৩টি।