নওগাঁ প্রতিনিধিঃ নওগাঁয় ২৪ ঘন্টায় ১ হাজার হেক্টর জমির বোরো আমন ধান ও ৭৬ হেক্টর জমির সবজি তলিয়ে গেছে। জেলায় মোট বোরো আমন ধান ৪ হাজার ১শ’ ৯ হেক্টর তলিয়ে গেছে। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে আত্রাই নদ ছোট যমুনার পানি এখন বিপদ সীমার সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ দিকে গত বন্যায় আত্রাই, রাণীনগর ও মান্দায় আত্রাই নদের বাধেঁর ভাঙ্গা অংশ মেরামত সম্পন্ন না হওয়ায় ওই অংশ দিয়ে হু-হু করে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে।
বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতের চেষ্টার মুহূর্তে কৃষকেরা দ্বিতীয় দফায় রোপনকৃত আমনের ধান আবার তলিয়ে গেছে। নওগাঁয় চতুর্থ দফায় বন্যায় আবারও নিন্মা ল প্লাবিত হয়েছে। নওগাঁয় খাল-বিল,নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মাঠের পর মাঠ তলিয়ে যাচ্ছে। এতে হাজার হাজার নতুন কৃষক ক্ষতির সমূখীন হচ্ছেন।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙনস্থানগুলো সময়মত মেরামত না করায় চতুর্থবার বন্যার কবলে পড়েছেন দুর্গত এলাকার মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ, আত্রাই, মান্দা ও রাণীনগরে ভাঙনস্থানগুলো মেরামতের আশ্বাস দিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু পাউবোর গাফলতি ও ঠিকাদারের অবহেলার কারণে সময়মত এসব ভাঙনস্থান মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
কৃষকদের দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের ভরসায় মাঠে মাঠে দ্বিতীয় দফায় আমান ধানের চারা রোপণ করেছিলেন তারা। বাড়তি দামে চারা কিনে রোপণ কাজে তাদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। কিন্তু বন্যার পানিতে ক্ষেতগুলো তলিয়ে যাওয়ায় চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে তাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আত্রাই নদের পানি ৩টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদের ধামইরহাটে শিমুলতলী পয়েন্টে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার, মান্দার জোতবাজার পয়েন্টে ৫১ সেন্টিমিটার এবং আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ রেলষ্টেশন পয়েন্টে ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে নওগাঁ ছোট যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে আত্রাই নদের ডান তীরের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের তিনটি ভাঙনস্থান দিয়ে হু-হু করে পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। ফলে তৃতীয়বারের মত বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে মান্দা উপজেলার বিষ্ণুপুর, নুুরুল্লাবাদ ও কশব ইউনিয়নের অনস্তত: ২২টি গ্রাম, আত্রাই উপজেলার আসহানগঞ্জ, শাহাগোলা, কালিকাপুর, পাঁচুপর, বিশা ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও রাণীনগর, বদলগাছী উপজেলার শতশত বিঘার ধান তলিয়ে গেছে।
আত্রাই উপজেলার তিলাবাদুরী গ্রামের রহিদুল ইসলাম জানান, তাদের মাঠে খুব ভালো আমন ধান হয়েছিল। কিন্তু বন্যায় তাদের মতো শতশত লোকের হাজার হাজার বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। জগদাশ গ্রামের পবিত্র কুমার জানান, আবারো বন্যা হওয়ায় তাদের সব জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতে আগামিতে পরিবার পরিজন নিয়ে কি খাবেন এখনি চিন্তা দেখা দিয়েছে।
মান্দা উপজেলার পার নুরুল্লাবাদ গ্রামের কৃষক আক্কাস প্রামানিক জানান, পাউবো ভাঙনস্থান মেরামত শুরু করায় একবুক আশা নিয়ে দুই বিঘা জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করেছিলেন। বাড়তি দামে চারা কিনে রোপণ কাজে তার ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার টাকা। একই গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলামের চার বিঘা জমিতে ১৭ হাজার ও গোলাম মোস্তফার তিন বিঘা জমিতে চারা রোপণ করতে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের পারশিমলা গ্রামের কৃষক জাহিদ হাসান ও নহলা কালুপাড়া গ্রামের আজিজার রহমানের রোপণ কাজে একই ধরণের ব্যয় হয়েছে।
মান্দা উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম গোলাম আজম বলেন, ‘গত জুলাই মাসের বাঁধভাঙা পানিতে প্রায় ২০ দিন ধরে তিন ইউনিয়নের অন্তত: ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী ছিল। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ফসলের মাঠগুলোতে কৃষকেরা আমনের চারা রোপন করেন। নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় গত শুক্রবার থেকে নুরুল্লাবাদ, জোকাহাট ও চকরামপুর এলাকায় বাঁধের ভাঙনস্থান দিয়ে আবারও পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
এতে সদ্য লাগানো আমন চারা ডুবে যাওয়ায় আবারও ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা।’ বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফলতি ও ঠিকাদারের অবহেলার কারণে এ অ লের মানুষকে তৃতীয়বারের মত বন্যার কবলে পড়তে হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে আমান ধানের ক্ষেত। পাউবোর আশ্বাসে মাঠে ধানের চারা রোপণ করে কৃষকরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’
মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান জানান, ‘ভাঙ্গনস্থান মেরামতের জন্য তার দপ্তর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডে আবেদন করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেগুলো মেরামত করে দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। পাউবোর আশ্বাস পেয়ে দুর্গত এলাকার কৃষকদের মাঠে আমন ধানের চারা রোপণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়মত ভাঙনস্থান মেরামত না হওয়ায় বন্যার পানিতে ওইসব এলাকায় প্রায় সাড়ে ৭শ’ হেক্টর বিঘা জমির আমন ধান তলিয়ে গেছে। এতে কৃষকরা আবারও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লেন।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুল ওয়াদুদ জানান, চতুর্থ দফায় জেলায় ২৪ ঘন্টায় ১ হাজার হেক্টর জমির বোরো আমন ধান ও ৭৬ হেক্টর জমির সবজি তলিয়ে গেছে। জেলায় মোট বোরো আমন ধান ৪ হাজার ১শ’ ৯ হেক্টর তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিক্ষতি গ্রস্থ্য হয়েছে আত্রাইয়ে। প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমি।
মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানিয়েছেন, পূর্বের ৩টি স্থানে যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড সেগুলোর মেরামতের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু মাটির অভাবে মেরামত কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন না হতেই দি¦তীয় পর্যায়ে পানি বৃদ্ধির কারনে আবারও সেসব স্থান দিয়ে পানি জনপদে ঢুকতে শুরু করেছে। এর উপর নতুন করে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় নুতন নুতন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এখনও কেউ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়গ্রহণ করেন নি।
আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানাউল ইসলাম জানিয়েছেন বিগত বন্যায় এই উপজেলায় আত্রাই নদীর মোট ৪টি পয়েন্টে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল। এর মধ্যে শিকারপুর, ভাঙ্গাজাঙ্গাল ও মালিপুকুর এই ৩টি স্থানে মেরামত করা হলেও আহসানগঞ্জ-এর নিকটে জাত আমরুল নামক স্থানের বড় ভাঙ্গনটি মেরামত কাজ চলছিল।
কিন্তু মেরামত কাজ শেষ না হতেই পুনরায় টানা ভারী বর্ষন এং উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে পুনরায় ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে নদীর পানি জনপদে প্রবেশ করেছে। এর ফলে আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ, পাঁচুপুর এবং নাটোর জেলার খাজুরা এবং নলডাঙ্গা’র বিশাল এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ফসল এবং বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গাফলতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান বলেন, চতৃর্থ দফার বন্যা একটু আগাম হয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে ভাঙনস্থানগুলো মেরামত করা সম্ভব হয়নি।