অনলাইন ডেস্ক: বাশার আল-আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় দীর্ঘ ৫৪ বছরের স্বৈরাচার পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। ১৯৭০ সালে বাশারের পিতা হাফিজ আল-আসাদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসনের শুরু হয়েছিল। বিদ্রোহীদের ঝড়ো অভিযানের মুখে শেষ পর্যন্ত গত ৮ ডিসেম্বর রোববার সকালে বিমানে রাশিয়া পালিয়ে যান বাশার আল-আসাদ। বিদ্রোহী বাহিনীর রাজধানী দামেস্ক দখল এবং আসাদ পরিবারের পালিয়ে যাবার খবরে হাজার হাজার উৎফুল্ল মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। অন্যদিকে সিরিয়ার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে ইসরাইলসহ বিভিন্ন সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীগুলো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন চক্রান্ত শুরু করেছে।
যেভাবে বাশার আল-আসাদের পতন
সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসনের শুরু হয় ১৯৭০ সালে। ৫৪ বছর ধরে এ পরিবার দেশটির রাজনীতিতে একক আধিপত্য ধরে রেখেছিল। তাদের শাসনামল চিহ্নিত হয়েছে গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য। আসাদ এবং তার স্বৈরশাসকের সহযোগীদের বিলাশবহুল জীবন থাকলেও সিরিয়ার দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছিল এবং অনেকেই উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছিল। যার ফলে সাধারণ সিরিয়ানরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ২০০০ সালে হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসেন। পেশায় একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ বাশারকে প্রথমে একজন সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হলেও, ক্ষমতায় আসার পর আস্তে আস্তে তিনিও পিতার মতোই কঠোর দমন-পীড়ননীতি অবলম্বন করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় পৌঁছানোর পর বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, যা আসাদের শাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। তখন আসাদ কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেন এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক অভিযান, ব্যাপক গণগ্রেফতার, বোমাবর্ষণ এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কারণে দেশটি ধীরে ধীরে গৃহযদ্ধের দিকে চলে যায়। তৈরি হয় নানা সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এবং গৃহযুদ্ধের মধ্যে ডুবে যায় দেশটি। ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্ব বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আসাদের ২৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের অভিযানে মাত্র ১২ দিনের মাথায় উৎখাত হলেন আসাদ। এদিকে দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালি। বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিদ্রোহীদের নেতা মোহাম্মদ আল বশির অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, সিরীয়দের জন্য এখন দরকার স্থিতিশীলতা ও শান্তি। তিনি বলেন, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে তিনি বাশার সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন।
কারা এ হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)
গত ২৭ নভেম্বর হতে সিরিয়ার ইদলিব থেকে বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা এইচটিএস প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি। গোলানির আসল নাম আহমদ হুসেইন আল সারা। জন্ম ১৯৮২ সালে, সৌদি আরবে। তার পরিবারের আদি নিবাস সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে এ মালভূমি দখল করে ইসরাইল। তখন বাস্তুচ্যুত হয় তার পরিবার। ৮০-এর দশকে আবার সিরিয়ায় ফেরত আসে তার পরিবার। ধারণা করা হয়, গোলান মালভূমির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্তার জানান দিতেই পরে নামের সঙ্গে গোলানি যুক্ত করেন বর্তমান এইচটিএসপ্রধান। আল কায়দা ও আইএসের সাবেক সৈনিক গোলানি ২০০৩ সালে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইরাকে যান। ধরা পড়েন মার্কিন সেনাদের হাতে। আল-জাজিরা জানায়, ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন কারাগারে ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে আসাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সিরিয়ায় ফেরত আসেন গোলানি। ইরাকের ইসলামিক স্টেটের তৎকালীন প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির পরামর্শে বিদ্রোহী-অধ্যুষিত ইদলিবে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আল কায়দার সিরিয়া শাখা আল নুসরা ফ্রন্ট। ২০১৩ সালে আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আইএস। সঙ্গে সঙ্গে আল নুসরাকেও আইএসের অংশ বলে দাবি করে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন গোলানি। তিনি আল কায়দার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখেন। একই বছর গোলানি ও নুসরা ফ্রন্টকে জঙ্গি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে গণমাধ্যমকে প্রথম সাক্ষাৎকার দেন গোলানি। আল-জাজিরাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে বেশ জ¦ালাময়ী বক্তব্য দিতে শোনা যায় তাকে। সিরিয়ায় শরিয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন তিনি। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ইরান ও রাশিয়ার সরাসরি সমর্থনে সিংহভাগ প্রদেশে বিদ্রোহীদের পরাজিত করে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। আলেপ্পোর পতনের পর বিদ্রোহী অধ্যুষিত ইদলিবে আশ্রয় নেন গোলানি। সেখানে গিয়ে আল কায়দা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ডাক দেন। নুসরা ফ্রন্টের নাম বদলে রাখেন জাবাত ফাতেহ আল-শাম। ২০১৭ সালে নিজের গোষ্ঠী ও ইদলিবে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহীদের নিয়ে এইচটিএস জোট প্রতিষ্ঠা করেন গোলানি। এ জোটই ২০১৭ থেকে ইদলিব শাসন করে আসছে। স্থানীয় গণমাধ্যম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানায়, গত সাত বছর শক্ত হাতেই ইদলিব শাসন করেছে এইচটিএস। প্রশাসনের সমালোচকদের গুম-খুনের পাশাপাশি বিরোধিতাকারী জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া বন্ধ রাখার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ বছর নভেম্বরে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আকস্মিক অভিযান শুরু করার পর সুর পাল্টে ফেলেন গালানি। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমসে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, আগের ‘বৈশ্বিক খেলাফত’ ও আল কায়দা-আইএসের মতাদর্শ থেকে সরে এসেছেন। সিএনএনের সাক্ষাৎকারে গোলানি বলেন, বিদ্রোহীদের সরকারে সিরিয়ায় অবস্থানরত সকল গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের আইনগতভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে। নতুন সরকারে সবাইকে জায়গা দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
গত কয়েকদিনে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাকে ‘মধ্যপন্থী’ ও ‘বাস্তববাদী’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সিরিয়া বিশেষজ্ঞ হাসান হাসানের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানায়, গোলানি এইচটিএসকে একটি বিশ্বস্ত শাসকগোষ্ঠী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। তারা ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে’, এমন ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করছে পশ্চিমা বিশ্বকে। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ায় আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর দেশটিতে অনেকগুলো আসাদবিরোধী গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। তাদের মধ্যে কুর্দি বিদ্রোহীদের পাশাপাশি বেশকিছু গোষ্ঠীকে সরাসরি সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। ২০১৭ সালে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার মিশন বন্ধ করে দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। এরপর থেকে বিদ্রোহীরা মূলত তুরস্কের কাছ থেকেই সমর্থন পাচ্ছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। তবে বেশকিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সাহায্য করলেও এইচটিএসকে জঙ্গিগোষ্ঠীর তালিকায় রেখেছে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘও তাদের জঙ্গিগোষ্ঠীর তালিকায় রেখেছে। তবে আসাদবিরোধী যুদ্ধে এইচটিএসের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পরোক্ষ সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। টাইমস অব ইসরাইল জানায়, এইচটিএস কখনো ইসরাইলে আক্রমণ করার হুমকি দেয়নি। আল-জাজিরার প্রতিবেদন ও সিএনএনের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, গোলানি একটি ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ তৈরির ব্যাপারেই বদ্ধপরিকর। সেই প্রজাতন্ত্র শরিয়া আইন কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
কোটি কোটি ডলারের সম্পদ ফেলে আসাদ পরিবারের রাশিয়া আশ্রয়
বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের অভিযানের মুখে একের পর এক শহরের পতনের পর রাজধানী দামেস্ক অভিযানের দিকে তাদের এগিয়ে আসার মুহূর্তে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে বাশার আল-আসাদ সপরিবারে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। ৮ ডিসেম্বর ক্রেমলিন সূত্রের বরাত দিয়ে রুশ সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্তি ও তাস জানিয়েছে, আসাদ পরিবারকে মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
রাজধাী দামেস্কে বাশারের প্রাসাদে ফেরারি, ল্যাম্বরগিনিসহ ৪০টির বেশি বিলাসবহুল গাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। ফুটেজে কয়েকটি লাল রঙের ফেরারি এফ৫০ (প্রতিটির বাজারমূল্য ৩০ লাখ ডলারের বেশি), একটি ল্যাম্বরগিনি, রোলস রয়েলস এবং বেন্টলিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি দেখা যায়। অন্তত একটি গাড়িতে দামেস্কের লাইসেন্স প্লেট লাগানো ছিল। সিরিয়ার উৎসুক জনতাকে গ্যারেজের গাড়িগুলো পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়।
বাশার আল-আসাদের আয়নাঘরে নির্যাতিত হাজারো মানুষ
বাশার আল-আসাদের ‘মানব কসাইখানা’ তথা আয়নাঘরে নির্যাতন চলত লাখো বন্দীর ওপর। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের কারাগারগুলো ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করে। দুর্বল ও বিভ্রান্ত বন্দীদের তারা আশ্বস্ত করেছে যে, তারা এখন নিরাপদ। বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার ভয়ংকর কারাগারগুলোর গোপন প্রকৃতি এবং সেখানে বন্দী অবস্থায় কাটানো অসংখ্য মানুষের দুর্দশার প্রমাণ তুলে সংগ্রহ করেছে। এ পর্যন্ত শতাধিক কারাগার শনাক্ত এবং সেখান থেকে অসংখ্য বন্দীকে মুক্ত করা হয়েছে। ‘মানব কসাইখানা’ তথা আয়নাঘর নামে পরিচিত বাশার আল-আসাদের কারাগারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হলো তাদমর ও সেদনায়া। তাদমর কারাগারটি পালমিরার মরুভূমিতে এবং সেদনায়া কারাগার দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত। এই দুটি ছিল সিরিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর কারাগার। ২০১৪ সালে ‘সিজার’ নামে পরিচিত সরকারি কর্মচারী সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি কারাগারগুলোয় বন্দী নির্যাতনের ওপর ৫৩ হাজার ২৭৬টি নথি প্রকাশ করলে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিদ্রোহীদের তল্লাশির সময় কুখ্যাত এই সেদনায়া কারাগারে ১৫ জন বেসামরিক নাগরিকের মরদেহ পাওয়া যায়। কারাগারটিতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে উদ্ধারকারীরা মরদেহগুলোর সন্ধান পায় বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস। নথিগুলো থেকে দেখা গেছে, অন্তত ৬ হাজার ৭৮৬ বন্দী সরকারি হেফাজতে মারা গেছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭ সালে সেদনায়া কারাগারকে ‘মানব কসাইখানা’ বলে আখ্যা দেয়। সংস্থাটি জানায়, সেখানে হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বা নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অনেককে খাবার, পানি ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এরপর মৃতদেহগুলো গণকবরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৩৪ জন সিরিয়ানকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ৫ হাজার ২৭৪ জন শিশু এবং ১০ হাজার ২২১ জন নারী। বাশারের বাবা হাফিজ আল-আসাদের শাসনামলেও বহু মানুষকে গোপনে অপহরণ করা হয়েছিল। আসাদের কারাগারে যেভাবে ‘ফ্লাইং কার্পেট’ পদ্ধতিতে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চলত। একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুসারে, বাশারের কারাগারে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার বন্দী ছিল। এদের মধ্যে অনেককে মুক্ত করা সম্ভব হলেও এখনো অসংখ্য মানুষ সিরিয়ার গোপন কারাগারে বন্দী আছে। সংবাদমাধ্যম জানায় সিরিয়ার কারাগারগুলোয় বন্দীদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে, তা অকল্পনীয়। তাদের চাবুক দিয়ে পেটানো, ঘুমাতে না দেওয়া, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা; এমনকি নগ্ন করে ধর্ষণ করা হতো। পুরুষ ও নারী উভয়ের ওপরই এসব নির্যাতন চালানো হয়েছে।
সিরিয়া পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ইসরাইল
সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশটির সংকটকালীন আধিপত্য বিস্তারের নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ইসরাইল। গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সিরিয়া-ইসরাইল সীমান্তের গোলান মালভূমির ‘বাফার জোন’ দখলের পর সিরিয়ার থাকা হারমন পর্বতের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সিরিয়ার বিমানবন্দর ও অস্ত্র কারখানাসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ৪৮ ঘণ্টয় ৪৮০ দফা বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে ব্যাপক ধ্বংসের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সিরিয়ার ভেতরে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দামেস্কের কাছে চলে গেছে ইসরাইলি বাহিনী। ১৯৮১ সালে ইসরাইল এটিকে নিজেদের সীমানার অন্তর্ভুক্ত করে মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এ অঞ্চলকে সিরিয়ার অধিকারভুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই অঞ্চলে ইসরাইলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সিরিয়ার ইসরাইলের হামলা ও অনুপ্রবেশের নিন্দা করেছে সৌদি আরব, কাতার, মিশর ও জর্দান। তারা একে ৭৪ সালের চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলাকে সমর্থন করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং রাশিয়ার প্রাধান্য ক্ষুণ্ন
এদিকে সিরিয়ায় ইরান ও রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এত বছর সিরিয়া শাসন করেছেন বাশার আল-আসাদ। তাকে সমর্থন দিয়ে আসছিল ইরান ও রাশিয়া। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া এবং ইরান বাশার আল-আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের কঠোর আক্রমণে হিজবুল্লাহর কোণঠাসা অবস্থা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্রমশ কমে আসা রাশিয়ার সম্পদ ও সরে যাওয়া মনোযোগ আসাদকে একা করে দেয় এবং বিদ্রোহীরা এ সুযোগটিই নেয়। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া এক বৈশ্বিক দাবা বোর্ডে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য মিত্রদের সাহায্য করার ভান ধরে আসছে। তুরস্ক, সৌদি আরব এবং মার্কিন সমর্থিত বিকেন্দ্রীভূত সশস্ত্র বিরোধীদলগুলো আসাদকে চ্যালেঞ্জ করছিল এতদিন। আসাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মূলত ইরান এবং রাশিয়ার কর্তৃত্বের পরাজয় হলো। লাভবান হলো ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র।
সূত্র: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা