‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ভবনায় কমবে গ্রাম-শহরের ব্যবধান


‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ভবনায় কমবে গ্রাম-শহরের ব্যবধান

মোঃ তৌহিদুজ্জামান
উপপ্রধান তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী

‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা’- এটি আমাদের অতি পরিচিত একটি সংবাদ শিরোনাম। এদেশে বড় বড় উৎসব উদযাপনে ছোট-বড় শহর থেকে গ্রামের দিকে মানুষের ছুটে চলার সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ গণমাধ্যম শিরোনামটি ব্যবহার করে থাকে। এখানে নাড়ির টান বলতে গ্রামের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ বোঝানো হয়, যে গ্রামে আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

বিগত এক দশকে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সে অগ্রগতির ছোঁয়া গ্রাম-শহর সবখানেই লেগেছে। চিরায়ত নিয়মে উন্নয়নের ছোয়া গ্রাম থেকে শহরেই বেশি লাগে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে সৃষ্ট কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলো শহরগুলোতে অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ফলে জীবিকার তাগিদের পাশাপাশি উন্নততর জীবন এবং আরাম-আয়েশের টানে মানুষ বেশি মাত্রায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের এক তথ্য মতে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল মাত্র ৯%। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ হার ৩১.৫১% বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন নগরায়নের হার ৩% এর বেশি। ১৯৭৪ সালে শহরের জনসংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র ৬২ লাখ তা ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে ৫ কোটি ২০ লাখ। চুড়ান্ত প্রতি্েবদনে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের এই ধারায় শহরে জনসংখ্যার চাপ অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম বিড়ম্বনা। রাজশাহী ছাড়া আমাদের আর কোনও শহরই পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে অতিরিক্ত জনসংখ্যা শহরগুলোতে আবাসন, যোগাযোগ অবকাঠামো, পরিবহন, পানি-বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ, স্বাস্থ্য সেবা, পরিবেশ সংরক্ষণ, খাদ্যের যোগান, পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলনিষ্কাশন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মত উদ্যোগগুলোকে অপ্রতুল ও অকার্যকর করে তুলেছে।

এ বাস্তবতা এবং আমাদের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদের গ্রাম-শহরের বৈষম্য দূরীকরণের অঙ্গীকারের আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ভাবনাকে যুক্ত করেন। সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নগর গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামে বৈদ্যুতিকরণ এর ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলের আমূল পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নামক ভাবনাতে ঘোষণা করলেন, উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুত গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ মানসম্পন্ন ভোগ্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামকে আধুনিক শহরের সকল সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

শহরের এসব সুবিধা গ্রামে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা। সরকার ইতোমধ্যে এ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। আগামী ৬ বছরে এ অর্থ স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তত্বাবধানে ব্যয় করা হবে। তারা এজন্য ২৮ কোটি টাকা ব্যায়ে ৩৬টি গবেষণা করছে। দ্রুতই এ সমীক্ষার কাজ শেষ হবে।

‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ভাবনার যাত্রা একেবারে শূন্য থেকে শুরু হচ্ছে এমনটা নয়। বিগত দুই মেয়াদে সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্যের অনেকটা পথ এগিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ খাতে। শতভাগ বিদ্যুতায়নে এখন দেশ। উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার প্রায় দ্বিগুন। সকল গ্রামের সাথে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এসময়ে দেশে গ্রামীণ সড়ক নির্মিত হয়েছে মোট ৬৩ হাজার ৭৪৭ কিলোমিটার । প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। তথ্য প্রযুক্তি খাতের এ অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণেই কোভিড-১৯ মহামারীর কঠিন সময়েও নানা ই-সেবার মাধ্যমে জীবন জীবিকার সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের জালে আটকে থাকা পল্লীর দরিদ্র মানুষের মুক্তি দিতে সরকারের ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পটি সামগ্রিক দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্যের এক যুগ অতিক্রম করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্রমপুঞ্জিভূত বিনিয়োগের পরিমান এখন ২০ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। প্রকল্পে গঠিত ১ লক্ষ ২০ হাজার ৪৬৫ টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির অধীনে উপকারভোগী ৫৬ লক্ষ ৭৯ হাজার পরিবার।

তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছে ১৮০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক। সারা দেশে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়েছে, ডাক্তারের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুন, বেড়েছে নার্সের সংখ্যাও। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নততর হয়েছে। একই সাথে বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং প্রতিটি উপজেলাতে কমপক্ষে ১টি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে।

এরকম অসংখ্য শহুরে সুবিধা নিশ্চিত করতে বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৩৭টির প্রকল্প চলমান রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ ইতোমধ্যে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১১৬ টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। পূর্বের চলমান ২৩৭ টি প্রকল্প ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এর লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই সরকার এই প্রকল্পগুলিকে এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এসব প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের যোগাযোগ ও বাজার অবকাঠামো, আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা, মানসম্মত শিক্ষা, নিরাপদ পানি, তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি স্পেস এবং বিনোদনের ব্যবস্থা, ব্যাংকিং সুবিধা, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কৃষি আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সব সুবিধা গ্রামগুলিতে নিশ্চিত করা হবে। এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এই মেগা প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ১৫ টি গ্রামকে পাইলট বেসিসে মডেল গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাইলট প্রোগ্রাম থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতা দেশের অন্যান্য গ্রামে আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণে সহায়তা করবে। ১৫ টি মডেল গ্রামের মধ্যে আটটি দেশের আটটি বিভাগে স্থাপিত হবে। বাকি ৭ টি হবে হাওর, উপকূলীয়, পাহাড়ি, চর, বরেন্দ্র ও বিল এলাকায় এবং একটি স্থাপিত হবে অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশে। পরের ৭টি গ্রাম দুর্গম ও সেখানকার পরিবেশ কিছুটা প্রতিকূল হওয়ায় ঐ অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। ফলে সেখানকার মডেল গ্রামগুলির বাস্তবায়ন গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নকে অনেক সহজ করে তুলবে।

মূলত গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষুন্ন রেখে শহর আর গ্রামের বিদ্যমান ব্যবধান কমিয়ে আনাই হচ্ছে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ভাবনার মূখ্য উদ্দেশ্য। এ ভাবনার যথাযথ বাস্তবায়ন আমাদের ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে করবে সহজতর এবং তারই ধারাবাহিকতায় দেশ ২০৪১ সালের মধ্যে জায়গা করে নেবে উন্নত দেশের কাতারে। সেই সাথে শহর ও ব্যবধান কমাতে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বাকি বিশে^র জন্য অনুকরণীয়।

– পিআইডি, রাজশাহী