বগুড়ায় বেচাকেনা হতে পারে ৪৮০ কোটি টাকার লাচ্ছা সেমাই


দীপক কুমার সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: পবিত্র ঈদুল ফিতর আসতে আর সপ্তাহ খানেক বাকী। মুসলিম সম্প্রদায়ের এই বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে সারাদেশের ন্যায় বগুড়ায় বিভিন্ন কারখানায় লাচ্চা সেমাই তৈরির প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। রমজানের শুরু থেকে তাদের তৈরী এসব প্রসিদ্ধ পণ্য কে কার আগে বাজার ধরতে পারে সে প্রতিযোগিতার কমতি নেই। এসব কারখানায় প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার টন লাচ্ছা সেমাই তৈরী হবে। এবার ছোট-বড় মিলিয়ে দেড় থেকে ২’শ কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই। এসব কারখানায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কর্মরত। ঈদ উপলক্ষে এসব কারখানায় নরমাল,ডালডা ও ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন হচ্ছে।

বগুড়ার তৈরি এসব লাচ্চা সেমাই যায় রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন জেলায়। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন কোম্পানি বগুড়া থেকে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে নিয়ে নিজেদের প্যাকেটে ভরে সারাদেশে নিজ কোম্পানীর নামে বিক্রি করে। সেমাই তৈরির জন্য জেলার আশপাশে বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে উঠেছে সেমাই পল্লী। আধুনিক মেশিনে মানসম্মত উপায়ে তৈরি হচ্ছে এসব লাচ্ছা সেমাই। তবে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী শ্রমিক দিয়ে ম্যানুয়ালি লাচ্ছা সেমাই তৈরি করছেন।

সমিতির নেতারা বলছেন, এখানকার লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফলে, এবার এই সেমাইয়ে বিক্রি ৪৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যা গত বছরের তুলনায় অন্তত ৫০ কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট এন্ড কনফেকশনারী দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতির ‘উত্তরবঙ্গ পরিষদ’ এর তথ্যমতে, বগুড়ায় প্রকারভেদে তিন ধরণের লাচ্ছা সেমাই তৈরি হয়। সয়াবিন, ডালডা এবং ঘিয়ে ভাজা। জেলায় প্রতিবছর রমজান মাসে অন্তত ১৫০টি কারখানায় লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন হয়। এরমধ্যে ব্র্যান্ডের কারখানা ৮ থেকে ১০টি। যারা মোড়কজাত করে এই সেমাই বাজারে বিক্রি করে। বাকিগুলো নন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। তারা খোলা বা বাঁশের খাচিতে করে লাচ্ছা সেমাই বাজারে বিক্রি করেন। এসব নন ব্র্যান্ড কারখানায় তৈরি লাচ্ছা সেমাইয়ের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই মৌসুমী। সব মিলিয়ে ১৫০টির অধিক কারখানায় প্রায় ১৬ হাজার টন লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন করা হয়।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা ডালডায় ভাজা প্রতি কেজি ১২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডের সয়াবিনে ভাজা লাচ্ছা প্রতি কেজি ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। ব্র্যান্ডের ডালডায় ভাজা লাচ্ছা ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, ঘিয়ে ভাজা ৮০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে। বগুড়ার ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে চিনিপাতা, শ্যামলী, এশিয়া, ফুড ভিলেজ, আকবরিয়া, নাহিদ এন্ড নাইম ফুড সহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ডালডায় ভাজা, ঘিয়ে ভাজা এবং প্রিমিয়াম কোয়ালিটির লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করে থাকে।

জানা গেছে, লাচ্ছা সেমাইয়ের মূল উৎপত্তি পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীনের আগে বিহারীদের হাতে ধরে এদেশে লাচ্ছা সেমাইয়ের প্রচলন হয়। বগুড়ার অধিকাংশ কারিগররা তাদের কাছে থেকেই লাচ্ছা সেমাই তৈরি শিখেছেন। পঞ্চাশের দশকে সৈয়দপুরে লাচ্ছা সেমাই প্রচুর তৈরি হতো। সেখানকার কারিগরদের হাতে ধরে শিখে বগুড়ায় চালু করা হয়। এরপর কালক্রমে বগুড়াই হয়ে উঠে উত্তরবঙ্গের লাচ্ছা সেমাই তৈরি ও বিক্রির ঘাঁটি।

বগুড়ার শ্যামলী হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের বেকারি শাখার ব্যবস্থাপক কীর্তণ কুমার দাস বলেন, ডালডা লাচ্ছা সেমাই আছে ২৪০ টাকা আর প্রিমিয়াম লাচ্ছা ২৬০ টাকা। এটা আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তবে এবার ঈদ উপলক্ষে বাজার তেমন একটা জমে ওঠেনি। গতবার দৈনিক আমাদের যেখানে ৮০-৯০ হাজার টাকার লাচ্চা সেমাই বিক্রি হতো। এবার ৩০-৪০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।

জেলার উত্তরবঙ্গ সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বায়েজিদ শেখ বলেন, বগুড়া লাচ্ছা সেমাই তৈরিতে দেশসেরা। এখানে প্রচুর দক্ষ কারিগর রয়েছে। স্থানীয় ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে অনেক কোম্পানি সেমাই তৈরি করে নিয়ে যায় এখান থেকে। লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা কমে না, বরং প্রতিবছরই বাড়ে। গতবার জেলা থেকে ৪০০ থেকে ৪৩০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। এবার সেই ব্যবসার পরিমাণ অন্তত ৪৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।

তবে বগুড়ায় গত দেড় মাস ধরে মৌসুমীসহ অন্তত ২৫০ ব্যবসায়ী লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে। প্রতি কারখানায় গড়ে ১০ জন করে কারিগর ধরলে জেলায় আড়াই হাজার মানুষ। এ কাজে নিয়োজিত বলে বেকারি ব্যবসায়ীর এই নেতা দাবী করেন।

জেলা বিসিক কার্যালয়ের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজ রহমান বলেন, বগুড়ায় লাচ্ছা সেমাইয়ের বৃহৎ বাজার রয়েছে। আমাদের বিসিকেও সেমাইয়ের কয়েকটি কারখানা আছে। এখানকার সেমাই উত্তরবঙ্গ ছাড়া ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় যায়। সেমাই শিল্পে উদ্যোক্তা যেভাবে তৈরি হচ্ছে আর এখানে দক্ষ কারিগর আছে তাতে একটা সময় এটা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি হবে।