মাথায় হাত তানোরের আলু চাষিদের


মনিরুজ্জামান মনি, তানোর: গত মৌসুমে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে লাভের আশায় আলু রোপন করেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষকরা। কিন্তু সেই আশায় পড়েছে হতাশার মেঘ। প্রতি বিঘায় ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের। যদিও বাজারে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোয়া। তাহলে কৃষকের কঠোর পরিশ্রম ও অধিক খরচের এবং ঝুকিপূর্ণ আলুর বাজার কেন এত কম এমন হাজারো প্রশ্ন চাষীদের।
কারা এই সিন্ডিকেট করে কৃষকদের পথে বসাতে মরিয়া,কে নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার, কারা দাম কমাচ্ছে বাড়াচ্ছে এধরনের প্রশ্নের কোন উত্তর খুজে পাচ্ছেনা কৃষকরা। অথচ আগাম আলু ১৮-১৯ টাকা কেজি দরে জমি থেকই বিক্রি করেছেন কৃষকরা। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, কীটনাশক সারের সিন্ডিকেটের শেষ নেই। বিশেষ করে রোপনের সময় দ্বিগুণ দামে কিনতে হয়েছে পটাশ সার। এতে করে যে কোন বছরের তুলনায় বিঘায় ১৫-১৮ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে, সেচের খরচও বাড়তি। অথচ আলু ১১ টাকা ৫০ পয়সা, ১২ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। নেই বহিরাগত আলু কেনা ব্যবসায়ীরা। ফলে চরম হতাশায় ভুগছেন আলু চাষিরা, দাম কম থাকায় কপালে জমেছে চিন্তার ভাজ।
আলু চাষি লুৎফর জানান, প্রতিবার ৯০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করি। গত মৌসুমে আগাম বিক্রির জন্য লোকসান কম হয়েছিল  ।  লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে এবারও ৭৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। আলু তোলা শুরু হয়েছে। সবকিছুর বাড়তি দাম। প্রতি বিঘায় ৫৫-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে এবং লোকসান হবে বিঘায় ১৪-১৫ হাজার টাকা করে।
চান্দুড়িয়া ইউপির গাগরন্দ গ্রামের গোলাম রাব্বানী জানান  গত মৌসুমে  ১২০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ৩ লাখ টাকা লোকসান হয়। এবারো একই পরিমান জমিতে লাভের আসায় আলু চাষ করি, বাজারে যে দাম  তাতে ২০-২৫  লাখ টাকা  লোকসান গুনতে হবে। তিনি পাচন্দর ইউপির বিনোদপুর মাঠে আলু চাষ করেছেন। আলু উত্তোলন চলছে। কীটনাশক সার ও সেচের অতিরিক্ত খরচ। বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম দ্বিগুণ হলেও আলুর বাজারে চরম ধস।
মাহবুর রহমান মিঠু নামের আরেক চাষি জানান গতবার ১৩৫  বিঘা জমিতে লোকসান হয়েছিল ১০ লাখ টাকা। সেই লোকসান নিয়ে লাভের আসায় পুনরায় একই পরিমান জমিতে চাষ করি। কিন্তু এবার খরচের টাকাও উঠবেনা। তিনি পাচন্দর ইউপির কচুয়া মাঠে আলু চাষ করেছেন এবং উত্তোলন চলছে।
  পাচন্দর ইউপির চিমনা গ্রামের কৃষক  শাপিউল জানান  গতবার ৬ বিঘা জমিতে আলু করে  ১ লাখ টাকা লোকসান হয়। লাভের আসায় ৭ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে খরচের টাকাও উঠছে না।
একই গ্রামের ওমর জানান গতবার ২০ বিঘা জমিতে প্রচুর  লোকসান হয়েছিল। এবার কমিয়ে ১০ বিঘা জমিতে চাষ করে পুরোটায় লোকসান হবে মনে হচ্ছে।
একাধিক আলু চাষিরা জানান, আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে হিমাগার মালিক সমিতি। তারা ইচ্ছেমত দাম নির্ধারন করে। তাদের সিন্ডিকেটের কারনে পথে বসতে হচ্ছে আমাদের।  প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে অথচ আলুর দাম নাই। তিনমাস কঠোর পরিশ্রম করার পর আলু উঠে। লাভের জন্য চাষ করা হয়। একমাস আগে আলুর বাজার ছিল ১৮-১৯ টাকা কেজি। সেই বাজার কমে ১১-১২ টাকা কেজিতে নেমেছে।
আলু রোপনের সময় দ্বিগুন দামে সার কীটনাশক কিনতে হয়েছে। যেখানে ১ বিঘা জমিতে খরচ হত ৪০-৪৫ হাজার টাকা, আর এবার ৫৫-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সার কীটনাশকের বাড়তি দামের কারনে পর্যাপ্ত দিত না পারায় বিঘায় ১২-১৪ বস্তা ফলন কম হচ্ছে। আলুর বাড়তি দাম হলে কৃষি দপ্তরের বিপনণ বিভাগ হৈচৈ ফেলে দেয়। এখন দাম কম চাষিরা পথে বসছে আর তারা নিরবতা পালন করছে।
এক কথায় কৃষক মরল কি বাচল সেটা কারো আসে যায় না। অথচ এই কৃষকরাই দেশে খাদ্য ঘাটতি ফেলতে দেয়নি। আর এদের নিয়েই মহা সিন্ডিকেট। কে শুনে কার কথা। আবার গভীর নলকূপ অপারেটরদের তো আছেই সেচ নিয়ে কারসাজি। বিদ্যুতের দাম বাড়তি বলে বিঘায় ১৫০০-২০০০ টাকা সেচ হার নিচ্ছে। যেখানে বিঘায় উর্ধ্বে ৪০০ টাকার বেশি সেচ হার লাগবেনা। এখানেও বেপরোয়া নৈরাজ্য।
গাগরন্দ গ্রামের আলু চাষি মুসলেম জানান, গতবার ৩০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। এবারও ৩০ বিঘা জমিতে আলুর চাষ করেছি। কয়েকদিন পর তোলা শুরু করব। বর্তমান বাজার অনুযায়ি ৩০ বিঘাতে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা লোকসান হবে। এভাবে লোকসান হলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে হিমাগার মালিক সমিতি। তাদের কাছে কৃষি বিপণন বিভাগ জিম্মি হয়ে আছে। তারাই যেটা করবে সেটাই সঠিক। তবে বিবিন্ন ভাবে খোজ নেওয়া হচ্ছে কোন অবস্থাতেই দাম বাড়বেনা, কিন্তু কমার সম্ভবনাই বেশি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মেদ জানান, এবারে উপজেলায় ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। যা দেশের তৃতীয়। নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য রোগবালা কম ছিল। দাম তো নির্ধারন করা কৃষি অফিসের কাজ না। এজন্য বিপণন বিভাগ রয়েছে। তবে বাজারে যে দাম আছে হিমাগারে রাখলে পরে দাম পাবে বলে মনে করেন তিনি।